Are you sure?

ইতিহাস »  ইতিহাস

১৯৪৮ সালের অপারেশন পোলো ও হায়দ্রাবাদ রাষ্ট্রে সংঘটিত ব্যাপক সহিংসতা ।

রাষ্ট্র-গঠন, সাম্প্রদায়িক হত্যাযজ্ঞ এবং ঐতিহাসিক নীরবতা বিষয়ক একটি গবেষণা । 

সারসংক্ষেপ:

১৯৪৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ভারতীয় সেনাবাহিনী হায়দ্রাবাদ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যে সামরিক অভিযান পরিচালনা করে, তা ইতিহাসে অপারেশন পোলো নামে পরিচিত। রাষ্ট্রীয় বর্ণনায় একে একটি দ্রুত, সীমিত ও প্রায় রক্তপাতহীন “পুলিশ অ্যাকশন” হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। কিন্তু পরবর্তী তদন্ত, সমসাময়িক বিবরণ এবং একাডেমিক গবেষণা বিশ্লেষণ করলে সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি বাস্তবতা সামনে আসে। এই গবেষণা নোটে সুন্দরলাল কমিটির প্রতিবেদন, প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ান এবং প্রাসঙ্গিক একাডেমিক সাহিত্য বিশ্লেষণের মাধ্যমে দেখানো হয়েছে যে হায়দ্রাবাদের অন্তর্ভুক্তিকরণ প্রক্রিয়া ছিল মুসলিম জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সংঘটিত ব্যাপক হত্যাকাণ্ড, ধর্ষণ ও লুটপাট দ্বারা চিহ্নিত—যা মূলধারার ভারতীয় ইতিহাসচর্চায় প্রায় উপেক্ষিত ও আড়ালকৃত।

ভূমিকা:

১৯৪৭ সালের পরে ভারত সরকার কূটনীতি ও সামরিক শক্তির সমন্বয়ে দেশীয় রাজ্যগুলোকে ভারতীয় ইউনিয়নে অন্তর্ভুক্ত করার প্রক্রিয়া শুরু করে। হায়দ্রাবাদের ঘটনা এই প্রক্রিয়ায় বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ, কারণ এখানে রাষ্ট্রীয় অন্তর্ভুক্তিকরণ সরাসরি মুসলিম জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ব্যাপক সহিংসতার মাধ্যমে সংঘটিত হয়। যদিও রাষ্ট্রীয় ভাষ্যে অপারেশন পোলোকে ‘আইন-শৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠার’ উদ্যোগ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়, বাস্তবে এটি বিপুল সংখ্যক বেসামরিক মানুষের প্রাণহানির কারণ হয়।

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট:

হায়দ্রাবাদ ছিল ব্রিটিশ ভারতের সবচেয়ে বড় দেশীয় রাজ্য, যেখানে শাসক ছিলেন একজন মুসলিম নিজাম, অথচ জনসংখ্যার অধিকাংশ ছিল অমুসলিম। স্বাধীনতার পর নিজাম হায়দ্রাবাদকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে টিকিয়ে রাখতে চেয়েছিলেন, যা নবগঠিত ভারতীয় রাষ্ট্রের রাজনৈতিক কৌশলের সাথে সাংঘর্ষিক হয়ে ওঠে।
১৩ সেপ্টেম্বর ১৯৪৮ সালে ভারতীয় সেনাবাহিনী হায়দ্রাবাদে প্রবেশ করে এবং মাত্র পাঁচ দিনের মধ্যে রাষ্ট্রটির অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়। তবে প্রকৃত সহিংসতা সংঘটিত হয় আনুষ্ঠানিক আত্মসমর্পণের পর, যা প্রমাণ করে যে নিহতদের বড় অংশ যুদ্ধকালীন সংঘর্ষের ফল ছিল না।

ব্যাপক সহিংসতার প্রমাণ:
৩.১ সুন্দরলাল কমিটির প্রতিবেদন:

১৯৪৮ সালের শেষদিকে ভারত সরকার পণ্ডিত সুন্দরলালের নেতৃত্বে একটি তথ্য-অনুসন্ধান কমিটি গঠন করে। এই কমিটির প্রতিবেদন দীর্ঘ সময় গোপন রাখা হয়। প্রতিবেদনে মুসলিম নিহতের সংখ্যা ২৭,০০০ থেকে ৪০,০০০ বলে অনুমান করা হয় এবং নিম্নলিখিত বিষয়গুলো উল্লেখ করা হয়—

মুসলিম বেসামরিক জনগণের পরিকল্পিত ও পদ্ধতিগত হত্যাকাণ্ড

ব্যাপক হারে মুসলিম নারীদের ধর্ষণ

মুসলিমদের সম্পত্তি লুট, ধ্বংস ও দখল

ভারতীয় সেনাদের উপস্থিতিতে বা নীরব সম্মতিতে সাম্প্রদায়িক মিলিশিয়াদের সহিংস কর্মকাণ্ড

এই প্রতিবেদন দীর্ঘদিন দমন করে রাখার ঘটনা প্রমাণ করে যে শুরু থেকেই রাষ্ট্রীয় বয়ান নিয়ন্ত্রণের একটি সচেতন প্রয়াস ছিল।

৩.২ উচ্চতর নিহতের সংখ্যা ও একাডেমিক বিতর্ক:

একাধিক ইতিহাসবিদ মনে করেন সুন্দরলাল কমিটির সংখ্যা সংযত (conservative)। গ্রামীণ এলাকায় হত্যাকাণ্ডের অপর্যাপ্ত নথিভুক্তি, গণকবর এবং অসম্পূর্ণ রেকর্ডের কারণে অনেক গবেষক নিহতের সংখ্যা এক লক্ষেরও বেশি, এমনকি কিছু ক্ষেত্রে দুই লক্ষের কাছাকাছি বলে অনুমান করেন। যদিও সুনির্দিষ্ট সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে, তবে সহিংসতার ব্যাপকতা ও সংগঠিত চরিত্র নিয়ে একাডেমিক ঐকমত্য বিদ্যমান।

যা ভারতীয় ইতিহাসবিদরা এড়িয়ে গেছেন, তা তুলে ধরেছেন বিদেশি গবেষকরা।

Wilfred Cantwell Smith (1950):   মুসলিমদের ১০–২০% প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ নিহত হতে পারে
একে আখ্যা দেন “Hyderabad: A Muslim Tragedy”
Margrit Pernau: যুদ্ধ নয়, বরং যুদ্ধ-পরবর্তী প্রতিশোধই ছিল সবচেয়ে ভয়াবহ

BBC–র Mike Thomson–এর অনুসন্ধান এই সত্যগুলো নতুন প্রজন্মের সামনে পুনরায় হাজির করেছে।

রাষ্ট্রীয় সম্পৃক্ততা ও সহিংসতা:

উপলব্ধ তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ভারতীয় রাষ্ট্র শুধু সহিংসতা প্রতিরোধে ব্যর্থ হয়নি; বরং কিছু ক্ষেত্রে তা নীরবে অনুমোদন করেছে বা কার্যত সহায়তা করেছে। সামরিক হস্তক্ষেপ ও সাম্প্রদায়িক হামলার মধ্যকার সীমারেখা ঝাপসা হয়ে যায়, যা ১৯৪৮ সালের হায়দ্রাবাদকে রাষ্ট্রীয় বলপ্রয়োগের বৃহত্তর ধারার অংশ হিসেবে চিহ্নিত করে।

ইতিহাসচর্চায় নীরবতা:

সহিংসতার ব্যাপকতা সত্ত্বেও অপারেশন পোলো ভারতীয় জাতীয় স্মৃতি ও শিক্ষাক্রমে প্রান্তিক অবস্থানে রয়েছে। সরকারি প্রতিবেদন দমন, বিচারিক অনুসন্ধানের অনুপস্থিতি এবং দায়বদ্ধতার অভাব এক ধরনের নির্বাচিত জাতীয় বিস্মৃতি (selective national amnesia)-র দৃষ্টান্ত। এটি দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনার তুলনায় স্পষ্টভাবে বৈপরীত্যপূর্ণ।

উপসংহার:

হায়দ্রাবাদের অন্তর্ভুক্তিকরণ কোনো শান্ত প্রশাসনিক প্রক্রিয়া ছিল না; বরং এটি ছিল ব্যাপক বেসামরিক প্রাণহানির মাধ্যমে সংঘটিত এক সহিংস রাষ্ট্র-গঠন প্রক্রিয়া। এই ইতিহাসের স্বীকৃতি ভারতের উপনিবেশ-উত্তর রাষ্ট্রগঠনের নৈতিক মূল্যায়নের জন্য অপরিহার্য। এই অধ্যায় উপেক্ষা করা মানে ঐতিহাসিক অবিচারকে দীর্ঘায়িত করা এবং রাষ্ট্রীয় একীকরণের নৈতিক বৈধতার দাবিকে প্রশ্নবিদ্ধ করা।

তথ্যসূত্র: