Are you sure?

বিজ্ঞান »  ইসলাম ও বিজ্ঞান

সূর্য কী সত্যিই আরশের নিচে সিজদাহ্ করে?

"সূর্যের আরশের নিচে সেজদাহ করা" সক্রান্ত বেশকিছু হাদিস বিভিন্ন ধরনের শব্দ ও বাক্যে বিভিন্ন গ্রন্থে বর্নিত হয়েছে। এসবের মধ্য হতে সবচেয়ে বিশুদ্ধতর দুইটি বর্ননা হলো বুখারি ও মুসলিমের বর্ননাগুলো।

ইমাম বুখারি, সুলাইমান আল-আ'মাশ হতে বর্ননা করেছেন: عن أبي ذر رضي الله عنه قال قال النبي صلى الله عليه وسلم لأبي ذر حين غربت الشمس أتدري أين تذهب قلت الله ورسوله أعلم قال فإنها تذهب حتى تسجد تحت العرش فتستأذن فيؤذن لها ويوشك أن تسجد فلا يقبل منها وتستأذن فلا يؤذن لها يقال لها ارجعي من حيث جئت فتطلع من مغربها فذلك قوله تعالى والشمس تجري لمستقر لها ذلك تقدير العزيز العليم [1]

এটি হচ্ছে মূল হাদিসের সংক্ষিপ্ত রূপ। হাদিসটি বিস্তারিতভাবে বর্নিত হয়েছে সহিহ মুসলিমে।

ইমাম মুসলিম, ইউনুস বিন উবাইদ হতে বর্ননা করেছেন: أتدرون أين تذهب هذه الشمسُ إن هذه تجرى حتى تنتهى إلى مستقرها تحت العرش فتخر ساجدة فلا تزال كذلك حتى يقال لها ارتفعى ارجعى من حيثُ جئتِ فترجع فتصبح طالعة من مَطْلَعِها ثم تجرى حتى تنتهى إلى مستقرها تحت العرش فتخر ساجدة فلا تزال كذلك حتى يقال ارتفعى ارجعى من حيث جئت فترجع فتصبح طالعة من مطلعها ثم تجرى لا يستنكر الناس منها شيئًا حتى تنتهى إلى مستقرها ذاك تحت العرش فيقال لها ارتفعى أصبحى طالعة من مغربك فتصبح طالعة من مغربها أتدرون متى ذاكم حين لا ينفع نفسًا إِيمانُها لم تكن آمنت من قبل أو كسبتْ فى إيمانِها خيرًا (مسلم عن أبى ذر) [2]

যেহেতু এটিই বিস্তারিত রুপ, সুতরাং মূল আলোচ্য বিষয় হচ্ছে সহিহ মুসলিমের এই হাদিসটি।

এবার এই হাদিসটি সম্পর্কে বিস্তারিত সাতটি পয়েন্টে আলোচনা করা হলো: 

এক.

"মহাবিশ্বের সকল গতিই কিছু প্রসংগ কাঠামো সাপেক্ষে আপেক্ষিক। "[3] "একজন পর্যবেক্ষকের সাথে একটি প্রসঙ্গ কাঠামো যুক্ত করে; সময়ের সাথে ঐ প্রসঙ্গ কাঠামোর সাপেক্ষে কোনো বস্তুর অবস্থানের পরিবর্তন নির্ণয়ের মাধ্যমে বস্তুটির গতি পর্যবেক্ষণ করা হয়।" [4][5]

সুতরাং যদি পৃথিবী পৃষ্ঠে অবস্থিত কোনো মানুষের দৃষ্টিকে প্রসংগ কাঠামো ধরা হয় এবং সেই প্রসংগ কাঠামোর সাপেক্ষে সূর্যের গতি বিবেচনা করা হয়, তবে গতির মূলনীতি অনুযায়ী 'সুর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘোরে' বললে কোনো ভুল নেই। এই আলোচ্য হাদিসটিতে প্রসংগ কাঠামো হলো মানুষের দৃষ্টি। কাজেই যদি এই হাদিসটি হতে ইংগিত পাওয়া যায় যে, পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘোরে, তবে তা অবৈজ্ঞানিক হবেনা। কেননা এখানে প্রসংগ কাঠামো হলো মানুষের দৃষ্টি। "হাদিসটিতে প্রসংগকাঠামো হলো মানুষের দৃষ্টি" এই কথার প্রমান হলো হাদিসে উল্লেখিত 'إن هذه تجرى কথাটি। এখানে ব্যবহৃত 'جري' শব্দটি দ্বারা সাধারনত চলন বুঝায়। কিন্ত যখন جري শব্দটি সুর্যের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয় তখন তা মানুষের দৃষ্টি সাপেক্ষে সূর্যের চলনকে নির্দেশ করে, جري শব্দটির এই ধরনের ব্যবহার রাসুলের (সা.) জন্মের পূর্ব থেকেই প্রচলিত ছিল। [6][7]

দুই.

মুসলিমের হাদিসটিতে বলা আছে, " ارجعى من حيث جئت فترجع فتصبح طالعة من مطلعها– "যেখান থেকে এসেছ ফিরে যাও, ফলে তা ফিরে যায় এবং সকালে তার উদিত হওয়ার স্থানে উদিত হয়।"

এখানে ফিরে যাওয়ার বিষয়টি দ্বারা মুলত সেজদাহ করার জন্য যেই স্থানটায় সুর্য যায় সেই স্থানটা থেকে ফিরে নিজের আগের অবস্থানে ফিরে যাওয়ার কথা বুঝানো হয়েছে।

বুখারির হাদিসটিতেও বলা হয়েছে: "ارجعي من حيث جئت فتطلع من مغربها" "যেখান থেকে এসেছ ফিরে যাও, ফলে তা পশ্চিম দিক হতে উদিত হবে।"

এখানেও "ফিরে যাওয়া" বলতে তার সিজদাহর স্থান হতে পুর্বের অবস্থানে ফিরে যাওয়ার কথাই বলা হয়েছে। তাকে ফিরে যেতে বলা হবে, ফলে তা অনুমতি না পেয়েই তার সিজদাহর স্থান হতে পূর্বের অবস্থানে ফিরে যাবে।

তিন.

হাদিসটিতে বলা হয়েছে যে, সূর্যের সিজদাহ করার স্থানটি হলো তার 'মুস্তাকার'।  'মুস্তাকার' এর অবস্থান কোথায় তাও বলে দেয়া হয়েছে যে, ইহা 'আরশের নিচে' অবস্থিত সমগ্র মহাবিশ্বে যা কিছু আছে, তার সব কিছুই আরশের নিচে অবস্থিত।

এ সম্পর্কে উলামাদের বক্তব্য:

  • ইবনুল কাইয়্যিম বলেন, "সমস্ত মাখলুকাত আরশের নিচে অবস্থিত।" [8]
  • ইবন তাইমিয়াহ বলেন, "সমস্ত মাখলুকাত আরশের নিচে অবস্থিত।"[9]
  • ইবনে কাসির বলেন, "সমস্ত মাখলুকাত আরশের নিচে অবস্থিত।" [10]
  • ইবন আবিল-আজ্জ বলেন, "সমস্ত মাখলুকাত আরশের নিচে অবস্থিত।" [11]
  • শামসুদ্দিন আয-যাহাবী বলেন, "সমস্ত মাখলুকাত আরশের নিচে অবস্থিত।" [12]

সুতরাং 'মুস্তাকার'(সূর্যের সিজদাহ্ করার স্থান) মহাবিশ্বের যেকোনো স্থানই হতে পারে। যার মানে হলো মহাবিশ্বে ছুটে চলা সূর্য চলমান অবস্থার মাঝেই তার মুস্তাকারে অবস্থান করতে পারবে।

চার. 

সূর্য একটা সময় থেমে যায়। অতঃপর থেমে সিজদাহ্ করে। তারপর সিজদাহ্ করে আবার আগের স্থানে ফিরে আসে। এই বিষয়গুলো হচ্ছে ইলমুল গাইব এর অন্তর্ভুক্ত বিষয়। অর্থাৎ এগুলো এমন বিষয় যা মানুষের পক্ষে কোনোভাবেই পর্যবেক্ষন করা ও আবিস্কার করা সম্ভব নয়। [13] মানুষের পক্ষে এসব ব্যাপার আবিস্কার করা সম্ভব না হওয়ার অনেক ধরনের কারণ থাকতে পারে। যেমন,  হতে পারে এসব ঘটনা ১ মিলি সেকেন্ডের কয়েক ট্রিলিয়ন ভাগের একভাগ সময়ের মধ্যেই সংঘটিত হয়ে যায়। যার ফলে মানুষ তা কখনোই পর্যবেক্ষন করতে পারবে না বা এই ধরনের কোনো কারণ হবে হয়তো। 

পাঁচ.

"فترجع فتصبح طالعة من مَطْلَعِها ثم تجرى حتى تنتهى إلى مستقرها تحت العرش– "ফলে তা ফিরে যায়, এবং সকালে তার উদয়স্থল হতে উদিত হয়, তারপর তা চলতে থাকে যতক্ষন না সে আরশের নিচে তার মুস্তাকার এ পৌছায়।  

'ফলে তা ফিরে যায়' অর্থাৎ মুস্তাকার হতে পূর্বের স্থানে ফিরে যায়। সকালে সূর্য উদিত হয়, আর তা সবাই দেখে। তারপর (মানুষের দৃষ্টি সাপেক্ষে) তা আকাশে চলতে থাকে এবং একটা সময় মুস্তাকার এ থেমে যায় এবং সিজদাহ্ করে।

ছয়. 

একই সময়ে পৃথিবীর একেক স্থানে সুর্যের অবস্থা একেক রকম হয়। কোনো-কোনো স্থানে যখন সূর্য উদিত হয়, তখন অপর কিছু স্থানে সূর্যাস্ত হয়। আবার কিছু স্থানে তখন বিকেল বা দুপুর হয়। হাদিসটি এই ধ্রুবসত্য বিষয়টিকে অস্বীকার করেনা। যদি এখানে বলা হত যে, সুর্য "রাত্রিবেলায়" সিজদাহ্ করে, তাহলে এরূপ দাবি করার মত একটা ভিত্তি থাকত। কিন্ত হাদিসটির কোথাও একথা বলা নেই। হাদিসটি হতে বুঝা যাচ্ছে যে, সূর্য উদিত হয় এবং সিজদাহ্ করে। সিজদাহ্ করে আর উদিত হয়, ধরে নিলাম সূর্য উদিত হওয়ার আগে সিজদাহ্ করে। এখন পৃথিবীতে প্রায় সবসময়ই কোনো না কোনো একটা স্থানে সূর্যোদয় ঘটছে। তো এরমানে কি এটা নয় যে, সূর্য সর্বদাই সিজদাহ্ করে? (কেননা যদি উদিত হওয়ার আগে সিজদাহ্ করা সূর্যের নিতি হয়, তবে অবশ্যই তার সর্বদা সিজদাহ্ করার কথা। কেননা সর্বদাই কোথাও না কোথাও সুর্যোদয় হচ্ছে) 

এর উত্তর হলো: "হ্যা"। সুর্য সর্বদা সিজদাহ্ করছে। সুরা হাজ্জ এর আয়াত ১৮ এ আল্লাহ তায়া'লা সূর্যের ক্ষেত্রে বলেছেন, "يسجد" (তা সেজদাহ করছে)। অধিকাংশ উচু পর্যায়ের উলামাগন একমত হয়েছেন যে, পৃথিবী গোল। [14][15] আর পৃথিবী যদি গোল হয় তাহলে অবশ্যই একই সময়ে সূর্যের অবস্থা পৃথিবীর একেক স্থানে একেকরম দেখাবে।

আবুল আব্বাস ইবন তাইমিয়াহ আলহাররানি আন্নুমাইরি (রহ.) বর্ননা করেছেন যে, ইমাম আবুল হুসাইন আহমাদ বিন জা'ফার বিন আল-মুনাদি (রহ) বলেছেন: "একইভাবে তাঁরা (আলেমগণ) একবাক্যে একমত হয়েছেন যে, ভুপৃষ্ঠ এবং সমুদ্র ধারণকারী পৃথিবী একটি গোলকের ন্যায়। তিনি বলেন, এর ইঙ্গিত তো পাওয়া যায় এই ব্যাপারটি থেকে- সূর্য, চন্দ্র এবং তারকারা পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে একই সাথে উদয় ও অস্ত যায় না। বরং এটি (উদয়-অস্ত) পশ্চিম দিকের চেয়ে পূর্বদিকে আগে ঘটে।" [16]

সাত.

হাদিসটিতে  বলা হয়েছে যে, কেয়ামতের সময় সিজদাহ্ করার পর আল্লাহ সূর্যকে বলবেন: "أصبحى طالعة من مغربك فتصبح طالعة من مغربها– তোমার অদৃশ্য হওয়ার স্থান হতে সকালে উদিত হও, ফলে তা সকালে তার অদৃশ্য হয়ার স্থান হতে উদিত হবে।

এখানে আল্লাহ সূর্যকে উক্ত আদেশটি করবেন, যা দ্বারা ইংগিত পাওয়া যাচ্ছে যে, সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘোরে। তবে এক্ষেত্রে এটা বৈজ্ঞানিকভাবে ভুল নয়! কেননা এই হাদিসটি বর্নিত হয়েছে মানুষের দৃষ্টিকে প্রসংগ কাঠামো ধরে উক্ত প্রসংগ কাঠামো সাপেক্ষে। (মানুষের দৃষ্টিকে প্রসংগ কাঠামো ধরে সেটার সাপেক্ষে সুর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘোরে বলাটা ভুল নয়।) যেহেতু হাদিসটি মানুষের দৃষ্টিকে প্রসংগকাঠামো ধরে উক্ত প্রসংগ কাঠামো সাপেক্ষে বর্নিত, সেহেতু এর দ্বারা যদি ইংগিত পাওয়া যায় যে, সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘোরে, তবে তা বৈজ্ঞানিকভাবে ভুল হবেনা। সুতরাং এটা কোনো বৈজ্ঞানিক ভুল নয়।

  1. হাদিসটির এই অংশ সম্পর্কে, আবুল ফাদ্বাল যাইনুদ্দিন আল-ইরাকী (রহ.) বলেন: "এর কারণ হলো ইহা কিয়ামতের প্রথম ধাপ, মহাকাশে বিশৃংখলা - গরমিল সৃষ্টি হবে যখন তা (সুর্যের পশ্চিম দিক হতে উদিত হওয়া) দেখা যাবে।" [17]
  2. মুহাম্মাদ আত-তাহির ইবন আশুর আল-তুনেসি (রহ.) বলেন: "যখন তা পশ্চিম দিক হতে উদিত হবে, অর্থাৎ যখন সুর্যের কিরণ-কে কেন্দ্র করে পৃথিবীর প্রদক্ষিনে ক্রুটি দেখা দিবে।" [18]

 

রেফারেন্স

  • [1] সহিহ আল'বুখারি হা/3027।
  • [2] সহিহ মুসলিম হা/159।
  • [3]→"All motions are relative to some frame of reference"
    https://www.britannica.com/science/motion-mechanics#ref187092
  • [4] Wahlin, Lars (1997). "9.1 Relative and absolute motion"  The Deadbeat Universe. Boulder, CO: Coultron Research. pp. 121–129.
  • [5] https://en.wikipedia.org/wiki/Motion?wprov=sfla1
  • [6] মুহাম্মাদ কুতরাব, আল-আযমিনাহ পৃ/16।
  • [7] ইবন সিদাহ, আল-মুহকাম 7/504।
  • [8] যাদুল মা'আদ 4/203।
  • [9] মাজমুয়ুল ফাওতাওয়া 6/581, 25/1998।
  • [10] আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়াহ 1/9-11।
  • [11 ]শারহুল আকিদাতিত ত্বহাওইয়াহ 1/311।
  • [12] আল-আরশ 1/327।
  • [13] আ'লামুল হাদিস (পৃ/1893),শারহুল মিশকাহ (11/3450), মিরকাতুল মাফাতিহ (8/3452), আশরাতুস সা'আহ (পৃ/144), শারহুস সুন্নাহ (14/95), আলমাফাতিহ (5/40), আলয়াসমা ওয়াস সিফাত  (2/274), তুহফাতুল আহওয়াযি (3/349), তারহুত তাছরিব (8/259), শারহুল মাসাবিহ (5/559), উমদাতুল কারি (15/120), আল'লামেউস সাবিহ (12/372)।
    [14] মাজমুয়ুল ফাতাওয়া: 25/195। 
  • [15]আল ফাসলু ফিল মিলাল: 2/78।
  • [16]মাজমুয়ুল ফাতাওয়া: 8/586। 
  • [17]তারহুত তাছরিব: 8/259। 
  • [18] আত-তাহরির ওয়াত তানওইর: 23/21।