Are you sure?

বিজ্ঞান »  ইসলাম ও বিজ্ঞান

সূরা গাশিয়াহ-তে কী পৃথিবীকে সমতল বলা হয়েছে?

 

সুরা 'আল-গাশিয়াহ'(ক্রম 88তম) - আয়াত নং 20 এ বলা হয়েছে : 

 

"و إلی الأرض كيف سطحت "

 

এই আয়াতটির প্রসংগের সুচনা হয়েছে 17 নং আয়াতটি থেকে, প্রসংগসহ আয়াতটি উল্লেখ্য করা হলো : (সুরা গাশিয়াহ, আয়াত 17-20)

 

أفلا ينظرون الي الإبل كيف خلقت, وإلی السماء كيف رفعت,والی الحبال كيف نصبت,و إلی الأرض كيف سطحت

 

"তারাকি দৃষ্টিপাত করেনা উটের দিকে যে কিভাবে তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে? এবং আকাশের দিকে, কিভাবে থাকে উচ্চ করা হয়েছে?  এবং পাহাড়ের দিকে, কিভাবে থাকে স্থাপন করা হয়েছে?  এবং আল-আর্দের দিকে, কিভাবে তাকে سطح করা হয়েছে?  

 

এখানে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে أفلا ينظرون (তারাকি দৃষ্টিপাত করেনা)। অর্থাৎ এখানে দৃষ্টিপাত করার কথা বলা হয়েছে। একজন মানুষের পক্ষে সমগ্র পৃথিবীর দিকে দৃষ্টিপাত করা সম্ভব নয়। বরং একজন মানুষ পৃথিবীর পৃষ্ঠ বা ভুমির দিকে দৃষ্টিপাত কর‍তে পারে। সুতরাং এই আয়াতটিতে আল-আর্দ বলতে সমগ্র পৃথিবী নয়, বরং পৃথিবীর পৃষ্ঠ বা ভুমি উদ্দেশ্য। 

 

আয়াতটিতে ব্যবহৃত سطح শব্দটির অর্থ "সমতল করা, চ্যাপ্টা করা " হয়। কিন্ত শব্দটির ভিন্ন প্রচলিত অর্থও আছে, سطح শব্দটি "বিছিয়ে দেয়া, বিস্তৃত করা, প্রসারিত করা, শয়ন করানো " অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। 

 

আল-খালিল আল-ফারাহিদী বলেছেন : 

"السَطْحُ : البَسْطُ، يقالُ في الحَرْب سَطَحُوهم أي أَضْجَعُوهم على الأرض" [1] 

"আস-সাতহু : আল-বাসতু (বিছিয়ে দেয়া, বিস্তৃত করা)। যুদ্ধের সময় বলা হয় 'তারা শত্রুদের  সাতহুন করে দিল, অর্থাৎ শত্রুদের মাটিতে বিছিয়ে (শয়ন করিয়ে) দিল " 

 

নাশওয়ান আল-হুমাইরি বলেছেন : 

"السَّطْحُ: البسط، سطح اللّاه تعالى الأرض: أي بسطها"[2] 

"আস-সাতহু : আল-বাসতু (বিছিয়ে দেয়া, বিস্তৃত করা), আল্লাহ তা'আলা আল-আর্দকে সাতহুন করেছেন অর্থাৎ তিনি তাকে বিছিয়ে দিয়েছেন,বিস্তৃত করেছেন " 

 

ইবন মানযুর আল-আফ্রিকি বলেছেন : 

"سَطَحَ الرجلَ وَغَيْرَهُ يَسطَحه، فَهُوَ مسْطوحٌ وسَطِيح: أَضْجَعَه وَصَرَعَهُ فَبَسَطَهُ عَلَى الأَرض وَرَجُلٌ مَسْطُوحٌ وسَطِيحٌ: قَتيلٌ منبَسِطٌ؛ قَالَ اللَّيْثُ: السَّطِيحُ المَسْطُوحُ هُوَ الْقَتِيلُ"[3] 

"সে একজন পুরুষ বা অন্য কিছুকে সাতহুন করল, সাতহুন করে বা করবে, ফলে তা সাতহুনকৃত হলো : (অর্থাৎ) সে তাকে শয়ন করালো, আছাড় দিলো ও ভুমির উপর বিছিয়ে দিলো, বিস্তৃত করে দিলো । এবং সাতহুনকৃত পুরুষ : যাকে হত্যা করে মাটিতে বিছিয়ে (শয়ন করিয়ে) দেয়া হয়েছে। আল-লাইস বলেছেন সাতিহ ও মাসতুহ মানে নিহত লোক " 

 

 

মুরতদ্বা আয-যুবাইদী বলেছেন : 

"سَطَحَه يَسْطَحه (كمَنَعه) فَهُوَ مَسْطُوحٌ وسَطِيحٌ: (بَسَطَه) . وَفِي حَدِيث عُمرَ رَضِيَ اللَّهُ عنهُ: قَالَ للمَرْأَةِ الّتي مَعهَا الصِّبْيَان: (أَطْعِمِيهم وأَنا أَسْطَح لَك) ، أَي أَبْسُطه حَتَّى يَبْرُدَ. (و) سَطَحَه: إِذا (صَرَعَه) أَو صَرَعَه فبَسَطه على الأَرص، كَمَا فِي (اللّسَان)"[4] 

"সে অমুককে সাতহুন করেছে, করে বা করবে, ফলে অমুক সাতহুনকৃত হলো। এবং উমার (রা) এর হাদিসে এসেছে যে তিনি এমন একজন মহিলাকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন যার সাথে দুইটি বালক ছিল : ( তাদেরকে খাওয়াও এবং আমি তোমার জন্য সাতহুন করে দিব) অর্থাৎ আমি তাদের পরিতৃপ্ত হয়ার আগ-পর্যন্ত খাদ্য বৃদ্ধি করে দিব। এবং সে অমুককে সাতাহ করল অর্থাৎ যখন সে তাকে আছাড় দিল, বা আছাড় দিয়ে যমিনে বিছিয়ে দিল (শয়ন করিয়ে দিল)। যেমনটা আল-লিসান এ আছে " 

 

ইবন সিদাহ আল-মুরসী বলেছেন : 

"سطَح الرجل وَغَيره يسطَحُه سَطْحا فَهُوَ مَسطُوحٌ وسطيحٌ، أضْجَعه وصرعه فبسطه على الأَرْض. وَرجل مسطوحٌ وسطيحٌ، قتل منبسط."[5]

"সে একজন পুরুষ বা অন্য কিছুকে সাতহুন করল, সাতহুন করে বা করবে, ফলে তা সাতহুনকৃত হলো : (অর্থাৎ) সে তাকে শয়ন করালো, আছাড় দিলো ও ভুমির উপর বিছিয়ে দিলো, বিস্তৃত করে দিলো । এবং সাতহুনকৃত পুরুষ : যাকে হত্যা করে মাটিতে বিছিয়ে (শয়ন করিয়ে) দেয়া হয়েছে।" 

 

আবু-মুসা আল-মাদিনী বলেছেন : 

"وأَصلُ السَّطْح: المَدّ والبَسْط. قال الله تَعَالى: وَإِلَى الْأَرْضِ كَيْفَ سُطِحَتْ"[6]

"এবং আস-সাতহু এর মুল অর্থ হলো : প্রসারিত করা, বিস্তৃত করা, বিছিয়ে দেয়া। আল্লাহ তা'আলা বলেছেন : এবং পৃথিবীর দিকে, কিভাবে তাকে সাতহুন করা হয়েছে " 

 

 

আস-সাহিব বিন আববাদ বলেছেন : 

"السَّطْحُ: بَسْطُكَ الشَّيْءَ على وَجْهِ الأرْضِ. وفي الحَرْب: سَطَحُوْهُم أي أضْجَعُوْهُم. والسَّطِيْحُ والمَسْطُوْحُ: هو القَتِيْلُ"[7] 

"আস-সাতহু : আপনার কোনোকিছুকে ভুমির উপর বিছিয়ে দেয়া, বিস্তৃত করে দেয়া, এবং যুদ্ধে : তারা শত্রুদের সাতহুন করে দিলো অর্থাৎ তারা শত্রুদের শয়ন করিয়ে দিলো, এবং যেই লোক (যুদ্ধে) সাতহুনকৃত সে নিহত " 

 

 

এডওয়ার্ড উইলিয়াম লেইন

বলেছেন : "سَطَحَهُ, (A, Ḳ,) aor. ـَ {يَسْطَحُ}, (Ḳ,) inf. n. سَطْحٌ, (Mṣb,) He spread it, spread it out or forth, or expanded it: (A, Mṣb, Ḳ:) this is the primary signification. (Mṣb.) You say, سَطَحَ ٱللّٰهُ الأَرْضَ, inf. n. as above, God spread, or expanded, the earth."[8] 

 

মুফাসসিরদের একটি বিশাল জামা'আত উক্ত আয়াতের سطح শব্দটির ব্যাখ্যা করেছেন "বিস্তৃত করা হয়েছে, প্রসারিত করা হয়েছে, বিছিয়ে দেয়া হয়েছে"। যেমন : 

 

কাতাদাহ,আছ-ছা'লাবী, আস-সাম'আনী, আবু-হাফস আন-নিসফী, আল-ওয়াহিদী, ইবনুল যাওযি,আল-বাকাঈ,আল-মাতুরিদী,আল-কিরামানী,ইবন আদিল,আশ-শাওকানী বলেছেন "বিছিয়ে দেয়া হয়েছে, বিস্তৃত করা হয়েছে " [9]। আল-কুরতুবী, আল-জাযযায, আস-সামিন-আল-হালবী বলেছেন "বিস্তৃত-প্রসারিত করা হয়েছে,বিছিয়ে দেয়া হয়েছে " [10]।আবুল-লাইস আস-সামারকান্দী বলেছেন : ভুপৃষ্ঠকে পানির পিঠে বিছিয়ে দেয়া হয়েছে [11]।ইবন কাসির বলেছেন : বিস্তৃত করা হয়েছে, বিছিয়ে দেয়া হয়েছে, প্রসারিত করা হয়েছে, প্রস্তুত-বিন্যাস্ত করা হয়েছে [12]। আল-খাযিন বলেছেন : বিস্তৃত করা হয়েছে, বিছিয়ে দেয়া হয়েছে, ও প্রস্তুত বিন্যাস্ত করা হয়েছে, যেখানে সবকিছুই তার (ভুমির) পিঠে অবস্থান করছে।[13]। জামালুদ্দিন আল-কাসিমী  বলেছেন : বিস্তৃত করা হয়েছে, বিছিয়ে দেয়া হয়েছে,  প্রস্তুত-বিন্যাস্ত করা হয়েছে [14] 

 

মুফাসসিরদের আরেকটা (ক্ষুদ্র) জামাত এর অর্থ "সমতল করা " ধরেছেন, এবং তাদের কেও কেও আবার এর উপর ভিত্তি করে পৃথিবীকে "সমতল" দাবি করেছেন। 

 

তাফসিরের মুলনিতী এই আয়াতের ক্ষেত্রে سطح শব্দটির অর্থ "বিস্তৃত করা, বিছিয়ে দেয়া " ধরাটাই অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত হিসেবে বিবেচিত। 

 

ড. হুসাইন বিন আলি আল-হারবী লিখেছেন : 

 

"إذا تنازع العلماء في تفسير الآية من كتاب اللّٰه و كان أحد الأقوال تؤيده آية أو آيات أخری و قراءة متواترة في نفس الآية لانها بمثابة الآية فهو أولی بحمل  الآية عليه " [15] 

 

"যদি উলামাদের মাঝে আল্লাহর কিতাবের একটি আয়াতের ব্যাখ্যা নিয়ে বিভিন্ন মত দেখা দেয়, এবং একটা মত এমন হয় যে আরেকটি আয়াত বা অপর একাধিক আয়াত বা সেই আয়াতেরই মুতাওয়াতির কিরা'আত (কেননা কেরাতই আয়াতের গন্তব্য) উক্ত মতটির পক্ষাবলম্বন করে- তাহলে সেই মত অনুযায়ি আয়াতের অর্থ গ্রহন করাই অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত "  

 

কোরানের অন্যান্য একাধিক আয়াতে আল-আর্দ এর ক্ষেত্রে সুস্পষ্টভাবে বিছিয়ে দেয়া, বিস্তৃত করা, প্রসারিত করা ইত্যাদি এই ধরনের শব্দ ব্যাবহৃত হয়েছে। অর্থাৎ আয়াতগুলো এই আয়াতের سطح শব্দটির অর্থ "বিস্তৃত করা, বিছিয়ে দেয়া " হয়ার পক্ষানলম্বন করছে। সুতরাং উসুলের আলোকে এই আয়াতের  سطح শব্দটির অর্থ "বিস্তৃত করা, বিছিয়ে দেয়া " ধরাটাই অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত ও অধিক সঠিক হিসেবে বিবেচিত। 

 

পৃথিবীতে ভুমিকে বিছিয়ে দেয়ার জন্য পৃথিবীর সমতল হয়াটা জরুরি নয়। সমগ্র পৃথিবী যদি গোলও হয়, তাহলেও তাতে ভুপৃষ্ঠকে বিস্তৃত করে বিছিয়ে দেয়া যাবে, ঠিক যেভাবে আমরা প্রতিদিন মাটিতে কার্পেট বিছাতে পারছি। যেহেতু পৃথিবীকে ভুমিকে বিছিয়ে দেয়ার জন্য সমগ্র পৃথিবীর সমতল হয়া শর্ত নয়, জরুরি নয়, সুতরাং এই আয়াতটি পৃথিবী সমতল হয়ার দলিল নয়।

 

এই আয়াত হতে যারাই পৃথিবীকে "সমতল " বলে দাবি করেছেন, মুফাসসিরদের একটা জামা'আত তাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। সেই মুফাসসিদের মধ্যে কয়েকজন হলেন : 

আব্দুর-রহমান আস-সা'দী,ইমাম ফাখরুদ্দিন আর-রাযী,মুহাম্মাদ আত-তাহির বিন আশুর,

ইবন আদিল আদ-দিমাশকী,ইবনুল খাতিব,মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-উসাইমিন,আস-সামিন আল-হালবি,ইসমাইল হাক্কী _[16] 

 

 

 

 

 

[1]আল-আইন (3/129) 

 

[2]শামসুল উলুম (5/3076) 

 

[3]লিসানুল আরব (2/482) 

 

[4]তাজুল উরুস (6/472)

 

[5]আল-মুহকাম (3/175)

 

[6]আল-মাজমুয়ুল মুগিস (2/86)

 

[7]আল-মুহিত ফিল লুগাহ (1/196)

 

[8]Lane's Arbic-English Lexicon (Page/1357)

 

[9]তাফসিরুত তাবারী (24/340),আল-কাশফ ওয়াল বায়ান (29/280),আত-তাইসির ফিত-তাফসির (15/324),তাফসিরুস সাম'আনী (6/215),আল-ওয়াযিয (1197), যাদুল মাসির (4/436),লুবাবুত তাফসির (3587), নিযমুদ দুরার (22/17), তা'ওইলাতু আহলিস সুন্নাহ (10/512),ফাতহুল কাদির (5/524), আল-লুবাব (20/302)

 

[10]তাফসিরুল কুরতুবী (20/36), মা'আনিয়ুল কোর'আন ও ইরাবুহ (5/319), উমদাতুল হুফফায (2/197) 

 

[11]বাহরুল উলুম (3/575) 

 

[12]তাফসির ইবন কাসির (8/374) 

 

[13]লুবাবুত তা'ওইল (4/422) 

 

[14]মুহাসিনুত তা'ওইল (9/462)

 

[15]কাওয়াইদুদ তারজিহ ইনদাল মুফাসসিরিন (পৃ/312)

 

[16]আল-লুবাব (20/302),তাফসিরুস সা'দী (পৃ/922),মাফাতিহুল গাইব (31/159),আত-তাহরির ওয়াত তানওইর (30/306),আললুবাব ফি উলুমিল কিতাব (20/302), উমদাতুল হুফফায (2/197),রুহুল মা'আনি (13/90-91),রুহুল বায়ান (10/424),  তাফসিরুল উসাইমিন আস-সাফফাত (পৃ/359),তাফসিরুল উসাইমিন আয-যুমার (পৃ/301),মাজমুয়ু ফাতাওয়া ওয়া রাসাইলুল উসাইমিন (8/644)