Are you sure?

বিজ্ঞান »  ইসলাম ও বিজ্ঞান

কোরানে বর্ণিত আকাশ সক্রান্ত কিছু সংশয় ও আপত্তির খন্ডন


*সুচিপত্র :

1. ভুমিকা -
   1.1 - আকাশ শব্দটির আরবি রুপ سماء প্রসঙ্গে 
   1.2 - ইসলাম, বৈজ্ঞানিক ফ্যাক্ট ও আকাশ প্রসঙ্গে

2. বর্ণনা -
    2.1 - প্রথম অভিযোগ "আকাশের স্তম্ভ থাকা বা না থাকার প্রশ্ন আসবে কেন?" ও এর জবাব
   2.2 - দ্বিতীয় অভিযোগ "ইসলাম অনুযায়ী পৃথিবী আকাশের আগে সৃষ্টি হয়েছে, যা কিনা একটি বৈজ্ঞানিক ভুল" ও এর জবাব
   2.3 - তৃতীয় অভিযোগ "হাদিস অনুযায়ী আকাশ ও যমীনের দুরত্ব পাচশত বছরের পর, যা কিনা আজগুবি ও বিজ্ঞানসম্মত নয় " ও এর জবাব
   2.4 - চতুর্থ অভিযোগ "আকাশ হচ্ছে ছাদ, আর এটা একটা বিজ্ঞানবিরোধী কথা, আকাশ আবার কিভাবে ছাদ হতে পারে?" ও এর জবাব
    2.5- পঞ্চম অভিযোগ "নিকটবর্তি আসমানে আবার নক্ষত্র থাকে কিভাবে! /নক্ষত্র শুধুমাত্র নিকটবর্তী আসমানেই আছে "  ও এর জবাব
    2.6- ষষ্ঠ অভিযোগ "কোরান অনুযায়ী আকাশ ও পৃথিবী স্থীর, যা কিনা বৈজ্ঞানিকভাবে ভুল " ও এর জবাব
    2.7 - সপ্তম অভিযোগ "আল্লাহ আকাশকে ধরে রাখেন যাতে তা পৃথিবীর উপর পতিত না হয়, এটা চরম অবৈজ্ঞানিক একটা কথা" ও এর জবাব
    2.8 - অষ্টম অভিযোগ "আকাশ থেকে টুকরা ভেংগে এসে ভুপৃষ্ঠের উপর পতিত হতে পারে, এদ্বারা প্রমাণিত হয় যে আকাশ শক্ত ঢাকনার মত কোনোকিছু " ও এর জবাব।
    2.9 - নবম অভিযোগ "আকাশে ফাটল বা ছিদ্র থাকার প্রশ্নই বা আসে কিভাবে?" ও এর জবাব
    2.10- দশম অভিযোগ "কোরান হাদিস অনুযায়ী আকাশের অনেকগুলো দরজা আছে, আর বৃষ্টিপাতও আকাশের দরজা দিয়েই হয় " ও এর জবাব
    2. 11- একাদশ অভিযোগ "কোরান অনুযায়ী আকাশকে/আকাশের আবরণকে অপসারিত করতে হবে, আর এটি বিজ্ঞানবিরোধী কথা " ও এর জবাব
    2.12 -  দ্বাদশ অভিযোগ "কোরান অনুযায়ী আকাশ কাগজের মত বস্তু, যাকে 'ভাজ' করা যায় বা 'গুটিয়ে নেয়া' নায়  " ও এর জবাব
   2.13 -  ত্রয়োদশ অভিযোগ "কেয়ামতের সময় আকাশ লাল গোলাপের মত হয়ে যাবে, এটা বৈজ্ঞানিক ভুল " ও এর জবাব
   2.14 - চতুর্থদশ অভিযোগ "কেয়ামতের সময় আকাশ গলিত ধাতু/তেলের তলানীর মত হয়ে যাবে যা বৈজ্ঞানিক ভুল " ও এর জবাব
   2.15 - পঞ্চদশ অভিযোগ "সুরা 25 এর আয়াত 25 এ বলা হয়েছে যে আকাশ মেঘমালাসহ বিদীর্ণ হবে ও ফেরেশতাদের নামিয়ে দেয়া হবে,এটা বিজ্ঞানবিরোধী কথা " ও এর জবাব
   2.16- ষোড়শ অভিযোগ "কোরানের অনেকগুলো আয়াতে বলা হয়েছে যে কেয়ামতের সময় আকাশ বিদীর্ণ হবে। অর্থাৎ বায়ুমন্ডল/মহাশুন্য হচ্ছে শক্ত কোনোকিছু যা ভেঙ্গে যেতে পারে " ও এর জবাব

3. উপসংহার -

4. টিকাসমুহ -

1.ভুমিকা :

এই লেখাটিতে কোরআনের আকাশ সক্রান্ত বিভিন্ন আয়াত হতে আনা বেশকিছু অভিযোগ ও আপত্তির জবাব ধারাবাহিকভাবে প্রদান করা হবে ইন-শা-আল্লাহ। মুল আলোচনায় যাওয়ার পুর্বে সমগ্র আলোচনাটি বোঝার জন্য অন্যান্য প্রয়োজনিয় কিছু বিষয় জানা আবশ্যক, সুতরাং সবার আগে এই ভুমিকা অংশটিতে সেবিষয়গুলো সম্পর্কে আলোচনা করা হবে।

(1.1)এক. 'আকাশ' শব্দটির আরবি রুপ 'سماء' (সামা) প্রসঙ্গে -

আরবি ভাষায় আকাশ অর্থাৎ 'সামা' এবং বাংলা ভাষায় 'আকাশ' , এদুটি আকাশ শব্দের মাঝে সংজ্ঞাগত পার্থক্য রয়েছে। বাংলা ভাষায় 'আকাশ' শব্দটির প্রাথমিক সংজ্ঞা হলো এরুপ : "আকাশ বি. পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের উপরাংশে (বিশেষত ভূপৃষ্ঠ থেকে যেমন দেখায়; আবহাওয়া পরিষ্কার থাকলে দিনের বেলা আকাশকে নীল দেখায়)"[1]।

অপরদিকে আরবি ভাষায় 'سماء' (সামা)শব্দটির প্রাথমিক সংজ্ঞা হলো : "কোনো জিনিসের উপরে অবস্থিত এক বা একাধিক যেকোনোকিছু বা সকলকিছু সেই জিনিসটির জন্য বা সেই জিনিসটির সাপেক্ষে সামা বা আকাশ " [2]

অর্থাৎ, যদি একটি বস্তু A এর উপর দিকে B নামক কোনোকিছু থাকে, তাহলে A এর জন্য বা A এর সাপেক্ষে B হবে সামা বা আকাশ। একইভাবে যদি A এর উপর C, D, E, F থাকে, তাহলে তাদের প্রত্যেকে এককভাবে A এর জন্য সামা বা আকাশ, আবার তারা সকলে মিলে সম্মিলিতভাবেও A এর জন্য সামা বা আকাশ হতে পারে, আবার তাদের মধ্য হতে ১-২ টা (যেমন শুধু C,D কিংবা শুধু F,E) পৃথকভাবে মিলেও A এর জন্য সামা বা আকাশ হতে পারে।প্রাথমিকভাবে আরবি ভাষাতে সামা বা আকাশ কথাটি ব্যবহৃত হয় 'আল-আর্দ' কে A   ধরে, অর্থাৎ যে জিনিসটির জন্য বা সাপেক্ষে সামা বা আকাশ বলা হবে সেটা ধরে নিয়ে।[3]আল-আর্দ মানে হলো পৃথিবীর পৃষ্ঠদেশ। আল-আর্দ দ্বারা সমগ্র পৃথিবীর পৃষ্ঠও বোঝায়, আবার অনেকসময় পৃথিবীর পৃষ্ঠের কিছু নির্দিষ্ট অংশকেও বোঝায় (এছাড়াও আল-আর্দের আরেকটা অর্থ হয় সরাসরি সমগ্র পৃথিবী)।

যদি আল-আর্দ A হয়, তাহলে পৃথিবীর পৃষ্ঠের ঠিক উপর থেকে আরম্ভ করে সমগ্র মহাবিশ্ব ও সমগ্র মহাবিশ্বের অন্তর্ভুক্ত সকলকিছুই অথবা এক বা একাধিক যেকোনোকিছুই  সামা বা আকাশ হতে পারে। (কোন ক্ষেত্রে সামা দ্বারা কি উদ্দেশ্য করা হয়েছে, তা বাক্যের প্রসঙ্গের উপর নির্ভরশীল।) তাছারা 'সামা' (আকাশ) শব্দটি অনেকক্ষেত্রে স্বয়ং এরই বহুবচন 'সামাওয়াত' এর সমার্থক হিসেবে ব্যবহৃত হয়, যার অসংখ্যা উদাহরণ কোরান, তাফসিরগ্রন্থ ও বিভিন্ন হাদিস বা আছারে বিদ্যমান।

এই বিস্তারিত বিষয়টিকে কম কথায় প্রকাশ করে এভাবে বলা যায় যে "পৃথিবীর পৃষ্ঠের উপরের দিকের এক বা একাধিক যেকোনোকিছু বা সকলকিছুই হলো সামা বা আকাশ।" বা "যা ই পৃথিবীপৃষ্ঠের উপরের দিকে আছে তাই আকাশ "।

সামা শব্দটির এই সংজ্ঞাটি অসংখ্যা আরবি সাহিত্যিক,  ভাষাবিদ ও বিভিন্ন ইসলামিশাস্ত্রের আলেমদের দ্বারা সমর্থিত। নিম্নে এমন প্রায় ৫০ জন আরবি ভাষাবিদ, সাহিত্যিক ও বিভিন্ন ইসলামিশাস্ত্রের আলেমদের নাম উল্লেখ্য করা হলো যারা উপরে বর্ণিত সামা শব্দের উক্ত সংজ্ঞাটির প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন ;- _[4]

ইবনু ফারিস, আল-ফাইয়ুমী, ইবনুল-মুলাক্কিন, আল-যাযযায, ইবনু তাইমিয়াহ, আল-আমিন, আস-সাময়ানী, ফাখরুদ্দিন, ইবনু আতিয়াহ, আল-ক্বাসিমী, আল-উসাইমিন, আল-কিরাফী, আল-কাদ্বী আইয়াদ্ব, ইবনু-আব্দিল-বার, আল-বাইদ্বাওই, আল-হাদ্দাদ, ইবনু খালিওয়াইহ, আস-সারখাসী, আয-যাহাবী, আস-সুহারী, ইবনু আদিল, মাক্কি, ইবনুল যাওযি, আল-হারাওই, আল-বাতালইয়াওসী, আত-তাইফাশী, ইবনু মানযুর, ইবনু আবিল আসবায়া, আত-তাবারী, আল-বায়হাকী, ইবনুল কাইইম, ইমাম আশ-শাফেঈ, আল-মুয়াল্লিমী, আল-কুরতুবী, আল-খাতিবুশশিরবিনী, ইমাম আল-মাতুরিদী, আস-সাদী, আল-বাক্বাঈ, ইবনু আশুর, আল-হাইতামী, সিদ্দিকহাসান খান, ফাদ্বিল আস-সামারাঈ, আস-সামিন, আল-মিনইয়াওই, আস-সাফারিনী, ইমাম আল-আশয়ারী, আব্দুল্লাহ আলফাওযান,
আশ-শানকিতিঈ, আল-হারালী এবং আস-সুহাইলী।

এই ৫০ জন ছাড়াও এখানে নাম উল্লেখিত হয়নি এমন আরো অসংখ্যা আলেম উনাদের বিভিন্ন গ্রন্থে সামা শব্দটির উক্ত সংজ্ঞাটিকে বিভিন্নভাবে সমর্থন করেছেন।

(1.2)দুই - ইসলাম, বৈজ্ঞানিক ফ্যাক্ট ও আকাশ প্রসঙ্গে -

ইসলাম আকাশ বা মহাশুন্যের ব্যাপারে খুবই সামান্য পরিমাণ তথ্য দিয়েছে। কাজেই শুধুমাত্র কোরান ও সহিহ হাদিস থেকে আকাশের ধরন প্রকৃতি ও অবস্থা সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারনা পাওয়া যায়না, বরং কোরান সুন্নাহতে বর্ণিত আকাশ সক্রান্ত তথ্যগুলোকে সকল ধরনের মহাকাশসক্রান্ত তত্ত্বে বা মডেলে ফিট করে নেয়া যায়। কোরান সুন্নাহতে বর্ণিত আকাশ সক্রান্ত তথ্যগুলোর সাথে আধুনিক বৈজ্ঞানিক ফ্যাক্টগুলোর সামঞ্জস্য সাধন করে (ভুপৃষ্ঠ সাপেক্ষে বর্ণনা করলে) আকাশের প্রকৃতি হয় অনেকটা এরকম যে ;-

ভুপৃষ্ঠের ঠিক উপরে রয়েছে বায়ুবিশিষ্ট শুন্যস্থান। ভুপৃষ্ঠ থেকে যত উপরে যাওয়া হয়, সেই শুন্যস্থানটিতে বায়ুর ঘনত্ব আস্তে আস্তে তত কমতে থাকে। অতপর আরো উপরে রয়েছে বায়ুমন্ডলের স্তরের সীমানা, সেই সীমানা পার হলে আরম্ভ হয় মহাশুন্যের। অতপর আরো উপরে বা দূরে গেলে পাওয়া যাবে বিভিন্ন ধরনের অসংখ্যা জৈতিস্ক। অতপর আরো অনেক দূরে গেলে পাওয়া যাবে প্রথম আসমানের শক্ত স্তর, যা কিনা মহাকাশের অতিমাত্রার  বিশালতার দরুন বিজ্ঞান কর্তৃক এখনো আবিষ্কৃত হতে পারেনি। অতপর প্রথম আসমানের স্তর থেকে আরো উপরে তথা দূরে গেলে পাওয়া যাবে দ্বিতীয় আসমানের শক্ত স্তর। এভাবে ক্রম অনুযায়ী মোট ৭ টি আসমানের স্তর পাওয়া যাবে। অতপর আরো উপরে গেলে পাওয়া যাবে কুরসী, এবং আরো উপরে গেলে পাওয়া যাবে আরশ। আরশ ও কুরসীর প্রকৃতি আল্লাহ ব্যাতিত আর কেও জানেনা। আবারসাত আসমানের ধরন সম্পর্কেও মানুষ এখনো জানতে পারেনি।

2.বর্ণনা :

এই বর্ণনা অংশটিতে ধারাবাহিকভাবে আকাশ সক্রান্ত বিভিন্ন অভিযোগের জবাব দেয়া হবে।

(2.1)
প্রথম অভিযোগ :- "কোরানের অনেক জায়গায় আকাশের স্তম্ভ না থাকার কথা এসেছে,আকাশ অর্থাৎ বায়ুমন্ডল শক্ত কঠিন হলেই এর স্তম্ভ থাকা বা না থাকার প্রসঙ্গ আসবে, এরমানে কোরান অনুযায়ী বায়ুমন্ডল হলো শক্ত কোনোকিছু, আর এই শক্ত বায়ুমন্ডল স্তম্ভ ব্যাতিত উপরে প্রতিষ্ঠিত হয়ে আছে।"

জবাব :

যেসব আয়াতে আকাশের স্তম্ভ না থাকার কথা বলা হয়েছে, সেকল আয়াতের প্রসঙ্গ অনুসারে বিচার করলে সেসব ক্ষেত্রে সামা তথা আকাশ বলতে ২ টা জিনিস উদ্দেশ্য করা হতে পারে, যথা : এক. বায়ুমন্ডল ও  দুই.আকাশের সাতটি শক্ত স্তর। কাজেই কোরানের আকাশের স্তম্ভ থাকা না থাকা সক্রান্ত আয়াতের বেলায় ধরে নিচ্ছি যে আকাশ বলতে হয় বায়ুমন্ডল উদ্দেশ্য, আর নাহয় সাতটা শক্ত স্তর উদ্দেশ্য।

অতপর, কোরানে আকাশের স্তম্ভ না থাকার আয়াতগুলোর ব্যাখ্যা নিয়ে উলামাদের মাঝে মতভেদ হয়েছে।আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রা) সহ একদল আলেম 'আকাশের স্তম্ভ নেই' বিষয়টিকে এই বলে ব্যাখ্যা করেছেন যে "আকাশের কোনো দৃশ্যমান স্তম্ভ নেই, কিন্ত এমন স্তম্ভ আছে যা মানুষ চোখে দেখতে পায়না অর্থাৎ আকাশের অদৃশ্য স্তম্ভ আছে"। পক্ষান্তরে আরেকদল মুফাসসিরের মতে 'আকাশের স্তম্ভ নেই ' মানে আকাশের কোনো স্তম্ভ নেই, দৃশ্যমান স্তম্ভও নেই, অদৃশ্য স্তম্ভও নেই, কোনো ধরনেরই স্তম্ভ নেই। _[5][6]

এদুটি মতের মধ্যে কোনটি অধিক সঠিক তথা অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত, তা অনেক জটিল ও লম্বা আলোচনার বিষয়, কিন্ত এখানে সেই আলোচনায় যাওয়ার কোনো দরকার পড়বেনা।

যদি ধরে নেই যে আকাশের স্তম্ভ না থাকার ব্যাখ্যা হিসেবে আকাশের কোনো ধরনেরই কোনো সম্ভ না থাকার মতটি সঠিক, সেক্ষেত্রে 'আকাশ' বলতে এখানে দুরকম অর্থ উদ্দেশ্য হতে পারে। হয় আকাশ দ্বারা 'বায়ুমন্ডল' উদ্দেশ্য, আর নাহয় 'সাত আসমান' উদ্দেশ্য।

যদি বায়ুমন্ডল উদ্দেশ্য হয়ে থাকে, সেক্ষেত্রে বলা হবে যে আকাশের স্তম্ভ নেই এমনটা বলে দেয়া দ্বারা উদ্দেশ্য ছিলো আকাশের স্তম্ভ আছে এমর্মে আহলুল-কিতাবদের মাঝে প্রচলিত বিশ্বাসটিকে খন্ডন করা, বাতিল করা । কেননা তৎকালীন সময়ে বহু ইহুদি খ্রিষ্টানরা আকাশের স্তম্ভ থাকাতে বিশ্বাসী ছিলো এবং কোরান-সুন্নাহর একটি বৈশিষ্ট হলো এই যে তা কিছু ইসরাইলি তথ্যকে খন্ডন করেছে [7]। একদল লোক বিশ্বাস করত যে আকাশ পিলারের উপর দাঁড়িয়ে আছে, এখন তাদের এই বিশ্বাসের বিরোধিতাস্বরুপ কোরান বলল যে আকাশের স্তম্ভ নেই। "যেখানে বায়ুমন্ডল কোনো শক্ত জিনিসই না সেখানে তার স্তম্ভ থাকা বা না থাকার প্রশ্নই বা আসে কিভাবে? " এরকম কথা এইখানে খাটবেনা, কারণ তৎকালীন আহলুল কিতাবরা বিশ্বাস ও প্রচার করতো যে আকাশের স্তম্ভ আছে, যার ফলে বায়ুমন্ডল শক্ত না হয়া সত্ত্বেও আকাশের স্তম্ভ থাকা বা না থাকার প্রশ্ন এসেছিল।যদি বায়ুমন্ডল না হয়ে সাত আসমান উদ্দেশ্য হয়ে থাকে সেক্ষেত্রেত ব্যাপারটা আরো সহজ। সাত আসমান হলো পৃথিবী হতে অকল্পনীয় দুরত্বে অবস্থিত মহাশুন্যের সাতটি কঠিন বা কঠিনের ন্যায় আচরণকারী স্তর। এসব স্তর কোনো ধরনের স্তম্ভ ব্যাতিত টিকে আছে ও সমগ্র মহাবিশ্বকে ঘিরে রেখেছে।

পক্ষান্তরে, যদি ধরে নেই যে আকাশের স্তম্ভ না থাকার ব্যাখ্যা হিসেবে "আকাশের কোনো দৃশ্যমান স্তম্ভ নেই, কিন্ত এমন স্তম্ভ আছে যা মানুষ চোখে দেখতে পায়না অর্থাৎ আকাশের অদৃশ্য স্তম্ভ আছে" এ মতটি সঠিক। সেক্ষেত্রেও এখানে 'আকাশ' বলতে দুরকম বিষয় উদ্দেশ্য হতে পারে। হয় এরদ্বারা 'বায়ুমন্ডল' উদ্দেশ্য, আর নাহয় 'সাত আসমান উদ্দেশ্য'।
উল্লেখ্য, এই মতটিতে বর্ণিত 'এমন স্তম্ভ বা মানুষ চোখে দেখতে পায়না ' বা 'অদৃশ্য স্তম্ভ' মানে এইনা যে একদম শাব্দিক অর্থেরই স্তম্ভ আছে যা কিনা অদৃশ্য। বরং 'অদৃশ্য স্তম্ভ' বলতে এমতটিতে উদ্দেশ্য 'আল্লাহর কুদরত ' তথা আল্লাহর ক্ষমতা [8]

এখন যদি এক্ষেত্রে বায়ুমন্ডল উদ্দেশ্য হয়, সেক্ষেত্রে ব্যাপারটার মর্ম দারাবে এই যে বায়ুমন্ডল ভুপৃষ্ঠের উপর আল্লাহর অদৃশ্য ক্ষমতার সাহায্যে টিকে আছে। আবার যদি এক্ষেত্রে সাত আসমান উদ্দেশ্য হয়, সেক্ষেত্রে ব্যাপারটার মর্ম দারাবে এই যে সাত আসমান আল্লাহর অদৃশ্য ক্ষমতার সাহায্যে টিকে আছে।

সুতরাং কোরানে আকাশের স্তম্ভ না থাকার বিষয়টি উল্লেখ্য করাদ্বারা এটা প্রমাণ হয়না যে কোরান অনুযায়ী বায়ুমন্ডল শক্ত কোনোকিছু।

(2.2)
দ্বিতীয় অভিযোগ :- "সুরা ফুসসিলাতের আয়াত ৯-১২ ও সুরা বাকারাহর আয়াত ২৯ এ একদম সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে পৃথিবী আকাশের আগে সৃষ্টি হয়েছে। যা কিনা বৈজ্ঞানিকভাবে সঠিক নয়। মহাশুন্যের আগে পৃথিবী সৃষ্টি হয়া কিভাবে সম্ভব? "

জবাব :

সুরা ফুসসিলাতের আয়াত  ৯-১২, সুরা বাকারাহর ২৯ ও সুরা নাযিয়াতের আয়াত ৩০ প্রসঙ্গে আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাসের (রা) একটি সামঞ্জস্যসাধনমুলক তাফসির রয়েছে। সেই ব্যাখ্যাটি উনার নিজ ইজতিহাদের দ্বারা প্রদানকৃত ও অন্য কোনো সাহাবি উনার সেই ব্যাখ্যাটির বিরোধিতা করেছেন বলে কোনো প্রমাণ নেই।  যার অর্থ এই আয়াতগুলোর জন্য প্রযোজ্য হতে পারা সবচেয়ে বেশি সঠিক, সবচেয়ে বেশি বিশুদ্ধ, সর্বোৎকৃষ্ট, সর্বোত্তম,  সবচেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্য ও সর্বাপেক্ষা অধিক অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত তাফসির হলো উনার সেই ব্যাখ্যাটি।

এই আয়াতগুলোর ব্যাপারে সাহাবি ইবন আব্বাস (রা) বলেছেন :

وخلق الأرض في يومين ثم خلق السماء، ثم استوى إلى السماء فسواهن في يومين آخرين، ثم دحا الأرض، ودحوها: أن أخرج منها الماء والمرعى، وخلق الجبال والجمال والآكام وما بينهما في يومين آخرين، فذلك قوله: {دحاها}. وقوله: {خلق الأرض في يومين}. فجعلت الأرض وما فيها من شيء في أربعة أيام، وخلقت السماوات في يومين [9] (الرواية الأولی)

তিনি পৃথিবীকে দুই ইয়মে সৃষ্টি করেছেন। তারপর আকাশ সৃষ্টি করেছেন, তারপর আকাশের দিকে মনোনিবেশ করে তাকে বিন্যাস্ত করেছেন অপর দুই ইয়াওমে, তারপর পৃথিবীকে বিস্তৃত ও প্রস্তত করেছেন, এবং তাকে বিস্তৃত ও প্রস্তুত করার অর্থ হলো তিনি তার মধ্য থেকে পানি ও তৃন নির্গত করেছেন, এবং তিনি পাহাড়, সৌন্দর্য ও উচু স্থান সহ  তাদের মাঝে যা আছে সৃষ্টি করেছেন অপর দুই ইয়াওমে। এবং এপ্রসংগে আল্লাহ বলেছেন "দাহাহা" এবং বলেছেন "খালাক্বাল আর্দা ফি ইয়াওমাইন"। সুতরাং পৃথিবী ও তার মধ্যে যা কিছু আছে তা সৃষ্টি হয়েছে মোট চার ইয়াওমে ও আকাশমন্ডলী সৃষ্টি হয়েছে ২ ইয়াওমে। (প্রথম বর্ননা)

তিনি আরো বলেছেন :

حيث ذَكر خَلْق الأرض قبل السماء، ثم ذَكر السماء قبل الأرض، وذلك أنّ الله خَلَق الأرض بأقواتها من غير أن يَدْحُوها قبل السماء، ثم استوى إلى السماء فسوّاهنّ سبع سموات، ثم دحا الأرض بعد ذلك، فذلك قوله: {والأَرْضَ بَعْدَ ذَلِكَ دَحاها}[10] (الرواية الثانية)

আল্লাহ একস্থানে পৃথিবীর সৃষ্টিকে আকাশের আগে উল্লেখ্য করেছেন, তারপর আকাশের কথা পৃথিবীর আগে উল্লেখ্য করেছেন, এবং তার কারন হলো এই যে আল্লাহ আকাশের পুর্বে প্রস্তুত ও বিস্তৃত করা ব্যাতিত পৃথিবীকে তার খাদ্যসহ সৃষ্টি করেছেন, তারপর আকাশের দিকে মনোনিবেশ করে তাকে সাত আসমানে বিন্যাস্ত করেছেন। তারপর পৃথিবীকে বিস্তৃত ও প্রস্তুত করেছেন। এবং প্রসংগেই বলা হয়েছে "ওয়াল আর্দা বা'দা যালিকা দাহাহা"। (দ্বিতীয় বর্ননা)

ইবনু আব্বাস (রা) এর এই ব্যাখ্যাটিতে কিছু অস্পষ্ট বিষয় আছে। কাজেই প্রথমে সেই অস্পষ্ট বিষয়গুলোর ব্যাপারে আলোচনা করা হবে এবং তারপর ইবনু আব্বাস (রা) এর উক্ত ব্যাখ্যাটির মর্ম সরলভাবে উল্লেখ্য করার চেষ্টা করা হবে।

অস্পষ্ট বিষয় ১ - "পৃথিবীর বিভিন্ন জিনিস সৃষ্টি হওয়ার সময়ে কি আকাশের বিভিন্ন গ্রহ-নক্ষত্র ও মহাকাশীয় বস্তু সৃষ্টি হচ্ছিলো? "

স্পষ্টকরণ - ইবনু আব্বাস (রা) এর ব্যাখ্যাটিতে এমন একটা বিষয় আছে যাদ্বারা অনেকের মনে হতে পারে যে আকাশের সকল জৈতিস্ক আর পৃথিবীর বিভিন্ন জিনিস একই সময়ে সৃষ্টি হচ্ছিলো।

সেবিষয়টি হচ্ছে প্রথম বর্ননার এই অংশটি :
'…وخلق الجبال والجمال والآكام وما بينهما في يومين آخرين…'

'… এবং তিনি পাহাড়পর্বত, সৌন্দর্য, উচুস্থান ও তাদের দুজনের মাঝে যা আছে সৃষ্টি করেছেন অপর দুই ইয়াওমে.... '

এখানে وما بينهما অর্থ 'তাদের দুজনের (আকাশ ও ভুপৃষ্ঠের) মাঝে যা আছে '। যার দরুন ব্যাহ্যিকভাবে মনে হচ্ছে যেন এখানে আকাশ ও ভুপৃষ্ঠের মাঝের মহাকাশীয় বস্তুসমুহকে সৃষ্টি করার কথা বলা হচ্ছে। কিন্ত বাস্তবতা আসলে এরকমটা না।

এই ما بينهما বা 'আকাশ ও ভুপৃষ্ঠের মাঝে যা আছে ' এর মধ্যে ভুপৃষ্ঠের ঠিক উপর থেকে আরম্ভ করে মহাকাশের সর্বশেষ সীমানা পর্যন্ত বিস্তৃত অকল্পনীয় ব্যাপ্তির বিশাল অঞ্চল ও উক্ত অঞ্চল অবস্থানকারী সকলকিছু অন্তর্ভুক্ত হয়,  ভুপৃষ্ঠকে স্পর্শ করা অবস্থায় যেসব জিনিস ভুপৃষ্ঠের উপরে অবস্থান করছে সেসব জিনিসও এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। [11]। এহিসেবে 'ভুপৃষ্ঠে যা কিছু আছে ' তাও 'আকাশ ও ভুপৃষ্ঠের মাঝে যা আছে ' কথাটি দ্বারা অন্তর্ভুক্তকৃত হতে পারে।

এখন ইবনু আব্বাস (রা) হতে বর্ণিত এই বর্ণনাটিতে 'আকাশ ও ভুপৃষ্ঠের মাঝে যা আছে' বলতে ব্যাপকার্থে বা সাধারন অর্থে আকাশ ও ভুপৃষ্ঠের মধ্যকার সকলকিছু বোঝানো হয়নি। বরং এই বর্ণনাটিতে 'আকাশ ও ভুপৃষ্ঠের মাঝে যা আছে ' বলতে আকাশ ও ভুপৃষ্ঠের মাঝে অন্তর্ভুক্ত হয়া 'ভুপৃষ্ঠ যা কিছু আছে ' কে নির্দিষ্টভাবে খাসভাবে উদ্দেশ্য করা হয়েছে। অর্থাৎ 'আকাশ ও ভুপৃষ্ঠের মাঝে যা আছে ' বলতে আকাশ ও ভুপৃষ্ঠের মাঝে অন্তর্ভুক্ত হয়া ভুপৃষ্ঠের সকল প্রাথমিক জিনিসপত্রকে বোঝানো হয়েছে। আর এই ব্যাপারটার পক্ষে প্রমাণ হলো এই যে - এই একই বর্ণনার অন্যান্য কিছু সংস্করনে এখানের وما بينهما এর বদলে ও বিকল্প হিসেবে ما فيها (যা কিছু ভুপৃষ্ঠে আছে) কথাটি বর্ণিত হয়েছে। [12]

অস্পষ্ট বিষয় ২ - "পৃথিবীকে প্রস্তুত বিন্যাস্ত করার আগেই কি তাতে খাদ্য ছিলো?"

স্পষ্টকরণ - দ্বিতীয় বর্ননাটির একটি অংশ হতে অনেকে দাবি করতে পারে যে ইবনে আব্বাসের (রা) ব্যাখ্যা অনুযায়ি পৃথিবীকে বিন্যাস্ত ও প্রস্তুত করার আগেই তাতে খাদ্য ছিলো। সেই অংশটি হলো এই :
'…خَلَق الأرض بأقواتها من غير أن يَدْحُوها قبل السماء…'

'… তিনি পৃথিবীকে বিস্তৃত প্রস্তুত করা ব্যাতিত তার খাদ্যসহ আকাশের আগে সৃষ্টি করেছেন …'

'আবু-জাফর মুহাম্মদ ইবনু জারির আত-তাবারী' এখানের এই بأقواتها (খাদ্যসহ) কথাটির ব্যাখ্যা করেছেন 'খাদ্য নির্ধারন করা সহ '[13]। অর্থাৎ পৃথিবীর আদিরুপ সৃষ্টি করা হয়েছিল তাতে  কি কি খাদ্য আর্বিভুত হবে সেগুলোর অস্তিত্বে আসার সুত্রসমুহ নির্ধারন করে দেয়া সহ, পৃথিবীতে খাদ্যের পুর্বপরিকল্পনা নির্ধারন করা সহ । এরমানে এইনা যে পৃথিবীর আদিরুপ সৃষ্টির সময়েই তাতে খাদ্য উপস্থিত ছিলো।

এখানে بأقواتها এর ব্যাখ্যা এটা ছাড়া আর অন্য কোনোকিছু হয়া সম্ভব না, কেননা যদি بأقواتها এর ব্যাখ্যা এটা না হয়ে শাব্দিকভাবে 'খাদ্যসহ' ই ধরে নেয়া হয়, তাহলে আবশ্যকভাবে এটাও মেনে নিতে হবে যে দ্বিতীয় বর্ণনার بأقواتها অংশটি মুনকার ও বাতিল। কেননা এখানে بأقواتها দ্বারা 'খাদ্যসহ ' উদ্দেশ্য হয়ে থাকলে তা প্রথম বর্ণনাটির স্পষ্ট বিরোধী হবে (প্রথমটিতে সুস্পষ্টভাবে বলে দেয়া হয়েছে যে পৃথিবীর প্রাথমিক সব জিনিসপত্রগুলো আকাশ সৃষ্টির পরে বিন্যাস্ত ও তৈরি করা হয়েছে) , এবং প্রথম বর্ণনাটির সনদ দ্বিতীয় বর্ণনাটির সনদের চেয়ে তুলনামুলকভাবে অনেক বেশি শক্তিশালি, এমনকি প্রথমটিত স্বয়ং সহিহ বুখারির বর্ণনা ; তার উপর আবার দ্বিতীয় বর্ণনাটির সনদে থাকা দুজন রাবি 'আলি ইবনু আবি-তালহাহ' ও 'আবু-সালিহ ' এর ব্যাপারে অভিযোগ আছে তারা মুনকার হাদিস বর্ণনা করতেন [14][15]।

কাজেই দ্বিতীয় বর্ণনাটির بأقواتها অংশের ক্ষেত্রে , হয় আত-তাবারীর দেয়া ব্যাখ্যাটি মেনে নিতে হবে, আর নাহয় মেনে নিতে হবে যে এই অংশটি মুনকার।

অস্পষ্ট বিষয় ৩ - "ইবনু আব্বাসের (রা) ব্যাখ্যা অনুযায়ী আলোচ্য আয়াতগুলোতে ছুম্মা শব্দের অর্থ কি? "

স্পষ্টকরণ- আলোচ্য আয়াতগুলোতে ব্যবহৃত 'ছুম্মা' শব্দটির একটি প্রচলিত ব্যবহার নিতী হচ্ছে এই যে এরদ্বারা অনেকক্ষেত্রে বর্নিত বিষয়বস্তুসমুহের মাঝে সময়ের ধারাবাহিকতা বুঝানো হয়না বরং শুধুমাত্র সংবাদ পরিবেশনের ধারাবাহিকতা বুঝানো হয়, অর্থাৎ 'ছুম্মা' শব্দটি অনেকক্ষেত্রে 'এবং' বা 'তাছারা' অর্থে ব্যবহৃত হয় [16]। আর কিছু মুফাসসিরদের মাঝে আলোচ্য বিষয়ে এমন একটা মতও প্রচলিত আছে যে আলোচ্য আয়াতগুলোতে ছুম্মা 'এবং' বা 'তাছারা' অর্থেই ব্যবহৃত হয়েছে [17]

এক্ষেত্রে যদি ধরে নেয়া হয় যে ছুম্মা শব্দটি 'অতপর' অর্থে ব্যবহৃত হয়ে সময়ের ধারাবাহিকতা নির্দেশ করছে, তাহলে আলোচ্য আয়াতগুলোর অর্থ দারাবে যে আল্লাহ প্রথমে পৃথিবীর সকল জিনিস সৃষ্টি, প্রস্তুত ও বিন্যাস্ত করেছেন , এবং তারপর আকাশ সৃষ্টি করেছেন। অপরদিকে ইবনে আব্বাসের ব্যাখ্যা অনুযায়ি প্রথমে পৃথিবীর আদিরুপ সৃষ্টি করেছেন, তারপর আকাশ সৃষ্টি করেছেন এবং তারপর পৃথিবীকে প্রস্তুত বিন্যাস্ত বিস্তৃত করে তাতে সকল জিনিস সৃষ্টি করেছেন। স্পষ্টতই, ছুম্মা দ্বারা সময়ের ধারাবাহিক ক্রম বুঝানো হচ্ছে বলে ধরে নিলে আয়াতগুলো হতে যেই তথ্যটি নির্গত হবে, তা ইবনে আব্বাসের (রা) প্রদানকৃত তাফসিরটির বিরোধী। সুতরাং ইবনে আব্বাসের (রা) ব্যাখ্যা অনুযায়ি আলোচ্য আয়াতগুলোতে ছুম্মা দ্বারা 'অতপর' বা 'তারপর' বুঝানো হয়নি বরং 'এবং' বা 'তাছারা' বুঝানো হয়েছে।

অর্থাৎ ইবনে আব্বাস (রা) এক্ষেত্রে ছুম্মার অর্থ 'তাছারা' ধরেছেন, 'অতপর' ধরেন নি।

অস্পষ্ট বিষয় ৪ - "ইবনু আব্বাসের ব্যাখ্যা অনুযায়ী এক্ষেত্রে আকাশ দ্বারা উদ্দেশ্য কী? "

স্পষ্টকরণ - প্রথম বর্ণনাটির কিছু সংস্করনে 'আকাশ ও ভুপৃষ্ঠের মাঝে ' কথাটি ব্যবহৃত হয়েছে। আর আকাশ ও ভুপৃষ্ঠের মাঝে কথাটি দ্বারা অন্তর্ভুক্তকৃত হয় মহাশুন্যের সর্বশেষ সীমানা হতে শুরু করে ভুপৃষ্ঠের ঠিক উপর পর্যন্ত বিস্তৃত অকল্পনীয় ব্যাপ্তির অঞ্চল ও সেই অঞ্চলে অবস্থান করা সকলকিছু। সমগ্র মহাশুন্য ও মহাশুন্যের সকল উপাদান এই 'আকাশ ও ভুপৃষ্ঠের মাঝে' এর অন্তর্ভুক্ত হয় । সুতরাং এক্ষেত্রে ইবনে আব্বাস (রা) আকাশ দ্বারা মহাশুন্য বুঝেন নি।কেননা  যদি এখানে আকাশ নিজেই মহাশুন্য হয়, তাহলে তার ও ভুপৃষ্ঠের মাঝে আবার কিভাবে মহাশুন্য থাকতে পারে!ইবনে আব্বাস (রা) এখানে মহাশুন্যকে সংজ্ঞায়িত করেছেন আকাশ ও ভুপৃষ্ঠের মাঝে অবস্থিত অঞ্চল হিসেবে। যার অর্থ এখানে আকাশ দ্বারা তিনি মহাশুন্যকে নির্দেশ করেন নি, বরং এমন একটা জিনিসকে নির্দেশ করেছেন ; যার ও ভুপৃষ্ঠের মাঝে মহাশুন্য রয়েছে।ভুপৃষ্ঠ ও আকাশের মাঝে যদি সমগ্র মহাশুন্য হয়, তাহলে অবশ্যই এই আকাশ দ্বারা মহাশুন্যের সর্বশেষ সিমানা উদ্দেশ্য হতে হবে। এখানে আকাশ দ্বারা মহাশুন্যের সর্বশেষ সিমানা উদ্দেশ্য হলেই আকাশ ও ভুপৃষ্ঠের মাঝে সমগ্র মহাশুন্য অন্তর্ভুক্ত হতে পারবে।সুতরাং এখানে আকাশ বলতে ইবনে আব্বাস (রা) মহাশুন্যের সিমানা নির্দেশক স্তরকে বুঝিয়েছেন।

এখন প্রশ্ন হলো যদি এখানে আকাশ বলতে এটাই উদ্দেশ্য করা হয়ে থাকে, তাহলে এখানে 'আকাশকে বিন্যাস্ত ' করার মানে কি?  এর উত্তর খুবই সোজা , এখানে আকাশকে বিন্যাস্ত করার মানে হলো সেই সীমানা নির্দেশক স্তর থেকে ৭ টা স্তর তথা সাত আসমান তৈরি করা, ভিন্নভাবে বললে সীমানা নির্দেশক স্তরটিকে সাত আসমানে বিন্যাস্ত করা। আর এই উত্তরটা কোনো ভিত্তিহীন নব্য আবিষ্কৃত বিষয় নয়!  বরং মধ্যযুগের সময় থেকেই মুফাসসিরদের মাঝে এমর্মে একটা মত প্রচলিত আছে যে সাত আসমানের সাতটি স্তর একটিমাত্র মুল স্তর থেকে বিন্যাসকৃত ও সৃষ্ট। [18]

ইবন আব্বাস (রা) কর্তৃক প্রদানকৃত ব্যাখ্যাটি হতে আকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টির সাথে সম্পর্কিত যেই ধারাবাহিক ক্রম পাওয়া যাচ্ছে তা হলো এরুপ :

প্রথমে অপ্রস্তুত অবিস্তৃত অবিন্যাস্ত অবস্থায় পৃথিবী সৃষ্টি হয়েছে। তারপর আকাশ অর্থাৎ মহাশুন্যের সর্বশেষ সিমানা নির্দেশক স্তরকে সৃষ্টি করে সেটাকে সাতটি স্তরে বিন্যাস্ত করা হয়েছে। তারপর পৃথিবীকে প্রস্তুত বিন্যাস্ত বিস্তৃত করা হয়েছে, তাতে সমস্ত উপাদান যেমন : গাছপালা, পশুপাখি, পানি, পাহাড়পর্বত ইত্যাদি সৃষ্টি করা হয়েছে।

এছারাও ইবনে আব্বাসের (রা) ব্যাখ্যাটি হতে আরেকটি গুরুত্বপুর্ন বিষয় সম্পর্কে জানা যায়, তা হলো এই যে ইবনে আব্বাসের (রা) মতে আলোচ্য আয়াতগুলোতে ছুম্মা দ্বারা 'অতপর' বা 'তারপর' বুঝানো হয়নি বরং 'এবং' বা 'তাছারা' বুঝানো হয়েছে। যার অর্থ এসব আয়াত দ্বারা অউদো কোনো ধারাবাহিকতা বোঝানোই হচ্ছেনা, এসব আয়াতের ছুম্মার অর্থকে 'তারপর' ধরলে আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টির যেই ক্রম পাওয়া যায়, সেই ক্রম বাস্তবে সঠিক না, বরং আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টির বাস্তব ধারাবাহিক ক্রম উক্ত আয়াতগুলোর ছুম্মার অর্থকে 'তারপর ' ধরার দরুন প্রাপ্ত ধারাবাহিক ক্রম হতে সম্পুর্ন ভিন্ন ধরনের। বাস্তব ক্রমটি হলো সেটা যা ইবনু আব্বাস (রা) বর্ণনা করেছেন, আলোচ্য আয়াতগুলোর ছুম্মার অর্থ 'তারপর' ধরলে যেই ক্রম প্রকাশিত হয় তা বাস্তব ক্রম নয়, বরং তা উলটো ইবনু আব্বাসের (রা) ব্যাখ্যাতে প্রদানকৃত ধারাবাহিক ক্রমটির বিরোধী।

(2.3)
তৃতীয় অভিযোগ :- " হাদিস অনুযায়ী নিকটবর্তী আকাশ ও যমিনের মধ্যকার দুরত্ব পাচশত বছরের পথ, প্রত্যেক আসমানের মধ্যবর্তী দুরত্ব ও আসমানসমুহের বিস্তৃতি পাচশত বছরের পথ। এসব কথা আধুনিক বিজ্ঞানের সাথে অসামঞ্জস্যশীল।  "

জবাব :

এমর্মে রাসুল (সা) হতে মারফুরূপে বর্ণিত প্রত্যেকটা হাদিসই সনদের দিক দিয়ে যইফ, এরমর্মের কোনো মারফু হাদিসই সহিহ নয় _[19][20]।

তবে এমর্মে ইবনু মাসউদ (রা) হতে মাওকুফরুপে একটি হাসান সনদের হাদিস বর্ণিত রয়েছে। ইবনু মাসউদ (রা) এর সেই বর্ণনাটির ব্যাপারে নিম্নে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো :

আব্দুল্লাহ ইবনু মাসউদ (রা) হতে একটি হাদিস মাওকুফরুপে বর্ণিত আছে। সেই বর্ণনাটিতে আসমান সমুহের মধ্যকার দুরত্ব, আসমানসমুহের প্রশস্ততা, নিকটবর্তি আসমান হতে যমীনের দুরত্ব, সপ্তম আসমান ও কুরসীর মধ্যকার দুরত্ব এবং কুরসী হতে আরশের দুরত্বকে ৫০০ শত বছরের পথ বলে উল্লেখ্য করা হয়েছে। বর্ণনাটি নিম্নে উল্লেখ্য করা হলো :

عن ابن مسعود رضي اللّٰه عنه قال بين السماء الدنيا و التي تليها خمسمائة عام و بين كل سماء مسيرة خمسمائة عام و غلظ كل سماء مسيرة خمسمائة و بين السماء السابعة و بين الكرسي خمسمائة عام و بين الكرسي و بين الماء خمسمائة عام و العرش فوق الماء و اللّٰه فوق العرش و لا يخفی عليه شيء من أعمالكم_[21]

অর্থ : ইবনু মাসউদ (রা) হতে বর্ণিত, তিনি বলেছেন যে নিকটবর্তী আসমান ও তার নিচের মধ্যকার দূরত্ব (অর্থাৎ নিকটবর্তী আসমান ও যমিনের মধ্যকার দূরত্ব) পাচশত বছরের পথ। এবং প্রত্যেক আসমানের মাঝের দূরত্ব পাচশত বছরের পথ। এবং প্রত্যেক আসমানের প্রস্থ পাচশত বছরের পথ। এবং সপ্তম আসমান ও কুরসীর মধ্যকার দূরত্ব পাচশত বছরের পথ, এবং কুরসী ও (আসমানের) পানির দুরত্ব পাচশত বছরের পথ। এবং আরশ পানির উপর অবস্থিত, এবং আল্লাহ আরশের উপর। এবং তোমাদের কোনো কার্যক্রমই তাঁর অজানা নয়।

এই বর্ণনাটিতে বর্ণিত পাচশত বছরের পথের দুরত্ব বা প্রস্থ হলো একজন সাহাবি কর্তৃক বর্ণিত ইলমুল-গায়েব সক্রান্ত তথ্য যা কোনো ধরনের ইজতিহাদ-কিয়াস বা মেধা ব্যবহার করে বলা সম্ভব না।

যখন কোনো সাহাবি ইলমুল-গায়েব সম্পর্কে এমন কিছু বলেন যা কোনো ধরনের ইজতিহাদ, চিন্তাভাবনা ও মেধাপ্রয়োগ দ্বারা বলা সম্ভব না ; তখন ধরে নেয়া হয় যে উক্ত সাহাবির বর্ণিত সেই তথ্যটির হুকুম মারফু। কিন্ত,

"যদি জানা যায় যে উক্ত সাহাবি ইসরাইলি তথ্যভান্ডার হতে কোনো তথ্য বর্ণনা করেছেন বা নিয়েছেন, সেক্ষেত্রে উনার বর্ণিত সেই মেধা-প্রয়োগমুক্ত ইলমুল-গায়েব সক্রান্ত তথ্যটির হুকুম মারফু হবেনা। কেননা এক্ষেত্রে সম্ভাবনা থাকে যে উক্ত সাহাবি সেই গায়েবসক্রান্ত তথ্যটি ইসরাইলি তথ্যভান্ডার হতে নিয়েছেন। "_[22]

এই নিতীটি কি শুধুমাত্র সেসব সাহাবিদের জন্য প্রযোজ্য, যারা খুব বেশি পরিমাণের ইসরাইলি তথ্য বর্ণনা করতেন?  নাকি সাধারণভাবে সেই সকল সাহাবিদেরই জন্য প্রযোজ্য, যারা ইসরাইলি তথ্য বর্ণনা করতেন ; সেটা হোক কম, হোক বেশি, হোক মাঝারি,  যেকোনো মাত্রাতেই হোক না কেন? …এনিয়ে কিছু 'অস্পষ্টতা' দেখা দেয় অনেকসময়।

"তবে এক্ষেত্রে সঠিক কথা হলো এই যে একজন সাহাবি ইসরাইলি তথ্য বর্ণনা করলেই তাঁর জন্য এই নিতী প্রযোজ্য হবে, এক্ষেত্রে বর্ণনার পরিমাণ কম হলো না বেশি হলো না মাঝারি হলো তা বিবেচনায় আনার বা হিসেবে নেয়ার কোনো দরকার নেই।"_[23]

এখন, ইবনু মাসউদ (রা) সেইসব সাহাবিদের অন্তর্ভুক্ত একজন, যারা কিনা ইবনু আব্বাসের (রা) মত করে ইসরাইলি তথ্যভান্ডার হতে বিভিন্ন জিনিস বর্ণনা করতেন। এবং সাহাবিদের কর্তৃক ইসরাইলি রেওয়ায়েত বর্ণিত হয়ার প্রসঙ্গে  অনেক আলেমরা ইবনু মাসউদ (রা) এর নাম ও উনার কর্তৃক বর্ণিত বিভিন্ন ইসরাইলি বর্ণনাকে উদাহরণ হিসেবেও এনেছেন। তাছারা সহিহ-যইফ মিলিয়ে বিচার করলে বর্তমানে বিভিন্ন গ্রন্থে ইবনু মাসউদ (রা) হতে মাওকুফরুপে বর্ণিত অনেকগুলো ইসরাইলি বর্ণনা সংকলিত রয়েছে, যেখানে ইবনু মাসউদ (রা) ইসরাইলি তথ্যভান্ডার হতে বিভিন্ন তথ্য বর্ণনা করেছেন। _[24][25]

সুতরাং এখানে ইবনু মাসউদ (রা) কর্তৃক বর্ণিত দুরত্ব ও প্রশস্ততার বিবরণগুলোর হুকুম মারফু হবেনা। আর যদি তা মারফু না হয়, তাহলে নিঃসন্দেহে এটা 'নির্ভুল' কোনোকিছু নয় বরং এটা ভুলও হতে পারে। সম্ভাবনা আছে যে তিনি এই বর্ণনাটি ইসরাইলি তথ্যভান্ডার হতে নিয়েছেন।

(2.4)
চতুর্থ অভিযোগ :- "কোরআন অনুযায়ী আকাশ হচ্ছে ছাদ। এবং এটা অবৈজ্ঞানিক। কোরানে আকাশকে ছাদ বলার ক্ষেত্রে بناء শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে, এবং بناء শব্দটি বিভিন্ন মানবনির্মিত স্থাপনার ছাদ বোঝানোর জন্য ব্যবহৃত হয়। যার অর্থ আকাশ হলো পৃথিবীর উপর মানবনির্মিত স্থাপনার ছাদের মতই শক্ত ছাদ, যা গম্বুজের মতো পৃথিবীর উপর রয়েছে। "

জবাব :-

কোরানের বিভিন্ন আয়াতে আকাশকে ছাদ বলার জন্য بناء শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে।[26]। কিন্ত সেসব আয়াতে আকাশকে بناء বলার দ্বারা মোটেও এটা বোঝানো হয়নি যে আকাশ হুবুহু সরাসরি আমরা যেসব স্থাপনার بناء (ছাদ) চিনি সেগুলোর মত।  বরং সেসব আয়াতে আকাশকে بناء তথা স্থাপনার ছাদ বলা হয়েছে সুস্পষ্ট উপমাস্বরুপ, অর্থাৎ সেসব আয়াতে আকাশকে بناء এর সহিত উপমা দিয়ে বোঝানো হচ্ছে যে একটা স্থাপনার জন্য উক্ত স্থাপনাটির ছাদ যেরকম ; ভুপৃষ্ঠের জন্য আকাশও সেরকম [27]।

আর এই উপমা একটি উদ্দেশ্যপুরণকারী স্বার্থক ও সঠিক উপমা। পৃথিবীবাসীর জন্য বায়ুমন্ডল অনেকটা কোনো স্থাপনার ছাদের মতই কাজ করে। বাসার ছাদ যেমন সেটার নিচে থাকা ব্যাক্তি বা বস্তুদের বিভিন্নভাবে বিভিন্ন বিষয় থেকে রক্ষা করে, একইভাবে বায়ুমন্ডলও তার নিচে ভুপৃষ্ঠে থাকা বিভিন্ন উপাদানকে বিভিন্ন ক্ষতি হতে রক্ষা করে।এই উপমা মোটেও ভুল না।

তবে এরদ্বারা এটা প্রমাণিত হয়না বা এটা হয়া জরুরি না যে আকাশের ব্যাহ্যিক দৈহ্যিক গঠন-প্রকৃতিকেও আমাদের পরিচিত স্থাপনাগুলোর ছাদসমুহের দৈহ্যিক গঠনের মত হতে হবে।কেননা এটা উপমা, আর উপমার বেলায় দৈহ্যিক গঠন-প্রকৃতির সাদৃশ্যতা থাকা জরুরি না, দুটা জিনিসের মধ্যে দুর-দুরান্ত পর্যন্ত বিন্দুমাত্র দৈহ্যিক গঠন-প্রকৃতির সাদৃশ্যতা না থাকলেও সেই দুটি জিনিসের কোনো একটি দ্বারা অপরটির জন্য শুদ্ধভাবে উপমা দেয়া যায়। এর কারণও স্পষ্ট, যেকোনোভাবে যেকোনো দিক দিয়ে যেকোনো উল্লেখ্যযোগ্য বিবেচনাযোগ্য বৈশিষ্টগত সাদৃশ্যতা থাকলেই উপমা দিয়ে দেয়া যায়, এর জন্য দৈহ্যিক গঠন-প্রকৃতির সাদৃশ্যতা না থাকলেও চলে বা থাকাটা জরুরি না।

যদি বিজ্ঞানের সবকিছুকে কিছুক্ষণের জন্য বাদ দিয়ে বিবেচনা করি, সেক্ষেত্রে এসব আয়াত হতে বড়জোর এতটুকু বলা যেতে পারে যে 'হয়তো بناء এর সহিত আকাশকে উপমা দেয়ার দ্বারা আকাশের গঠন-প্রকৃতি ও بناء এর গঠন-প্রকৃতির সাদৃশ্যতা উদ্দেশ্য, যার অর্থ হয়তো আকাশ সমতল পৃথিবীর উপর এক ধরনের গম্বুজ '। অর্থাৎ তখন এটা বড়জোর একটা সম্ভাবনা, ধারনা, তত্ত্ব, অনিশ্চিত বিষয় হিসেবে বলা যেতে পারে। কিন্ত কোনোক্ষেত্রে কোনোভাবেই উক্ত আয়াতগুলো দ্বারা এটা প্রমাণিত হয়না হতে পারেনা যে আকাশের গঠন-প্রকৃতিও بناء এর গঠন-প্রকৃতির মতো। কারণ প্রাথমিকভাবে আকাশকে এই بناء এর সহিত উপমা দেয়ার দ্বারা আকাশের গঠন-প্রকৃতি ও بناء এর গঠন-প্রকৃতির সাদৃশ্যতা উদ্দেশ্য হয়া জরুরি না, আবশ্যক না, না হলে বিন্দুমাত্র জটিলতা দেখা দিবেনা ; তবে (বিজ্ঞান কে বাদ দিয়ে বিবেচনা করলে) এটা হয়া কমপক্ষে সম্ভব যে এই উপমা দ্বারা এটাও বোঝানো হয়েছে যে আকাশের গঠন-প্রকৃতি بناء এর গঠন-প্রকৃতির মতো।

এখন প্রশ্ন আসতে পারে, তাহলে অমুক মুফাসসিররা কেন এসব আয়াতকে কেন্দ্র করে বললেন যে আকাশ ঠিক গম্বুজের মত ছাদ?  উনারা কেন এই আয়াত হতে বললেন যে আকাশের গঠন প্রকৃতি ও بناء এর গঠন প্রকৃতি একইরকম? এই প্রশ্নের জবাবে বলব : প্রথমত, বহু এমন আলেমরা আছেন, যারা এই আয়াতকে কেন্দ্র করে এমন কিছু বলেন নি, কাজেই এইটা এক-শ্রেণীর মুফাসসিরদের ধারনা বা তত্ত্বমাত্র, যাদের তাফসির নিয়ে ভালোমতো ধারনা আছে তারা অবশ্যই এবিষয়টা জানে যে প্রায়সময়ই মুফাসসিররা উনাদের বিভিন্ন ব্যাক্তিগত ইজতিহাদ ও কিয়াসভিত্তিক তত্ত্ব বা ধারনা বিভিন্ন আয়াতের তাফসিরে বর্ণনা করে থাকেন। দ্বিতীয়ত, বিভিন্ন আলেম হতে এরকম বিভিন্ন আজব তত্ত্ব মুলত ইসরাইলি তথ্যসমুহের প্রচার প্রসারের প্রভাব হিসেবে দেখা যায়, এটা খুবই সুপ্রতিষ্ঠিত ও জানা বিষয় যে সালাফ থেকে শুরু করে খালাফ পর্যন্ত প্রায় সকল যুগেই তাফসিরশাস্ত্রে ইসরাইলি তথ্যভান্ডারের খুবই উচ্চমাত্রার প্রভাব বিদ্যমান ছিলো, বিভিন্ন সত্য-মিথ্যা মিশ্রিত ইসরাইলি তথ্য প্রায় সব যুগের মুফাসসিরদেরই চরমভাবে প্রভাবিত করেছে। 'সমতল পৃথিবীর উপর আকাশ গম্বুজের ন্যায় ছাদ' এই তত্ত্ব যে ইসরাইলি তথ্যভান্ডারের অন্তর্ভুক্ত একটা জিনিস, তার পক্ষে বিপুল সংখ্যাক দলিল প্রমাণ রয়েছে।

অপরদিকে, কোর'আনের অনেক স্থানে البَنْيُ ধাতুটির বিভিন্ন ক্রিয়ারুপ আকাশের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন : _[28]

أَفَلَمْ يَنظُرُوا إِلَى السَّمَاء فَوْقَهُمْ كَيْفَ بَنَيْنَاهَا وَزَيَّنَّاهَا وَمَا لَهَا مِن فُرُوجٍ, وَالسَّمَاء بَنَيْنَاهَا بِأَيْدٍ وَإِنَّا لَمُوسِعُونَ, وَالسَّمَاء وَمَا بَنَاهَا … ইত্যাদি ইত্যাদি

এইধরনের আয়াতগুলোর  بَنَيْنَاهَا, بَنَاهَا ইত্যাদি এধরনের কথাগুলোকে অনেকে بناء এর সাথে গুলিয়ে একাকার করে ফেলে। কিন্ত এটা সঠিক না।  এখানে ব্যবহৃত এই শব্দগুলো البَنْيُ ধাতু থেকে এসেছে, আর البَنْيُ এর প্রকৃত অর্থ হচ্ছে 'অস্তিত্ব দেয়া ' বা 'অস্তিত্বে আনা'।[29] অবশ্য البَنْيُ ও بناء এর মাঝে সম্পর্ক আছে, তবে তা البَنْيُ হতে আগত ক্রিয়াসমুহের মুল প্রাথমিক প্রচলিত সাধারণ অর্থ হতে খুবই দূর-দুরান্তের বিষয়।

কোরানে আকাশকে ছাদ বলার জন্য بناء ছারাও আরেকটি শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে কিছু কিছু স্থানে, আর সেটা হচ্ছে 'سقف' শব্দটি [30]। سقف এর সংজ্ঞা হলো 'এমন যেকোনোকিছু যা উপরে অবস্থান করে তার নিচের উপাদানগুলোর যত্ন নিচ্ছে বা তত্ত্বাবধান করছে '[31]।

এবার আসা যাক আকাশের শক্ত হয়া না হয়া নিয়ে। প্রথমত, সাত আসমানের সাতটি স্তর যে শক্ত, এতে কোনো সন্দেহ নেই। মুল প্রশ্ন হচ্ছে বায়ুমন্ডল শক্ত কিনা সেটা। দ্বিতীয়ত, বায়ুমন্ডলকে بناء এর সহিত উপমা দেয়ার দ্বারা এটা প্রমাণিত হয়না যে বায়ুমন্ডল শক্ত কোনোকিছু , কেননা বায়ুমন্ডল কঠিন পদার্থের কিছু না হলেও এর সাথে بناء এর উপমা দেয়াটা সম্পুর্ণ সঠিক ও স্বার্থক হয়, যেহেতু বায়ুমন্ডল শক্ত কিছু না হলেও ভুপৃষ্ঠের জন্য তা অনেকটা ছাদের মতই কাজ করে। আর উপমার বেলায় যে ব্যাহ্যিক দৈহ্যিক গঠন প্রকৃতির সাদৃশ্যতা থাকাটা জরুরি না, সেব্যাপারে উপরে লম্বা বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।

আর বায়ুমন্ডলকে سقف এর সাথে তুলনা দেয়ার দ্বারা কোনোভাবেই এটা প্রমানিত হয়না যে বায়ুমন্ডল শক্ত কোনোকিছু। কেননা سقف এর মুল সংজ্ঞতে এমন কিছুই নাই যে সেটাকে কঠিন পদার্থের কিছু হতে হবে, বরং তা যেকোনোকিছুই হতে পারে, তা কি হবে সেটা নির্দিষ্ট কোনো বিষয় না। বায়ুমন্ডল ভুপৃষ্ঠের উপরে অবস্থান করে ভুপৃষ্ঠের তত্ত্বাবধান করছে, যত্ন নিচ্ছে, সুতরাং سقف এর সংজ্ঞা অনুযায়ী বায়ুমন্ডল হচ্ছে سقف।এখানে শক্ত কিছু হবে নাকি বায়বীয় কিছু হবে, এই প্রশ্ন আসার কোনো প্রসংগই নেই, সুযোগই নেই।

(2.5)
পঞ্চম অভিযোগ :- "কোরান অনুযায়ী নিকটবর্তি আসমানে নক্ষত্র আছে, অর্থাৎ বায়ুমন্ডলে নক্ষত্র আছে। যা কিনা চরম অবৈজ্ঞানিক " অথবা "কোরান অনুযায়ী নক্ষত্র শুধুমাত্র নিকটবর্তি আসমানেই আছে "।

জবাব :

কোর'আনের বিভিন্ন স্থানে আল্লাহ তায়ালা নিকটবর্তি আসমানকে নক্ষত্র দ্বারা সজ্জিত করার কথা বলেছেন। …[32]

নিকটবর্তি আসমানের দুরকম মানে হতে পারে। হতে পারে এরদ্বারা শাব্দিক অর্থেই নিকটবর্তি আসমান তথা বায়ুমন্ডল বোঝাচ্ছে। আবার হতে পারে যে নিকটবর্তি আসমান বলতে বায়ুমন্ডল উদ্দেশ্য নয়, বরং মহাকাশের একটা বিশাল বড় অঞ্চল উদ্দেশ্য তা তুলনামুলকভাবে আমাদের সাপেক্ষে অধিক নিকটতর।[33]

এবার মুল আলোচনায় আসা যাক।

যদি ধরে নেই যে নিকটবর্তি আসমান বলতে পৃথিবীর চারদিকের মহাশুন্যের একটা বিশাল অঞ্চল উদ্দেশ্য , এবং উক্ত আয়াত অনুযায়ি নিকটবর্তি আসমানে নক্ষত্র আছে ; তাহলে এরদ্বারা কখনৌই এটা প্রমানিত হয়না যে নিকটবর্তি আসমানের বাহিরে নক্ষত্র নেই। কেননা এই আয়াতগুলো শুধুমাত্র এটা জানাচ্ছে যে নিকটবর্তি আসমানকে নক্ষত্র দ্বারা সজ্জিত করা হয়েছে, নিকটবর্তি আসমানের বাহিরে নক্ষত্র থাকাকে অস্বিকার করে, এমন কোনোকিছুরই অস্তিত্ব উক্ত আয়াতগুলোতে নেই। এই আয়াতগুলো এটা অস্বিকার করছেনা যে নিকটবর্তি আসমানের বাহিরেও নক্ষত্র থাকতে পারে বা আছে। সুতরাং এই ইস্তেদলালটিতে প্রকাশ্য ক্রুটি বিদ্যমান। এর কোনো ভিত্তিই নেই।নিকটবর্তী আসমানকে নক্ষত্র দ্বারা সজ্জিত করার অর্থ হলো নিকটবর্তি আসমানকে নক্ষত্রের "সৌন্দর্য " ও "আলো" এর মাধ্যমে সজ্জিত করা [34][35]। যদি ধরে নেই যে নিকটবর্তি আসমান বলতে বায়ুমন্ডল অথবা মহাকাশের বিশাল পরিমাণ তুলনামুলক নিকটবর্তী অঞ্চল উদ্দেশ্য, সেক্ষেত্রে বলা হবে যে নক্ষত্রের সৌন্দর্য বা আলো প্রদর্শনের জন্য তার স্বয়ং নিকটবর্তি আসমানে বিদ্যমান হয়ার প্রয়োজন নেই। নক্ষত্র যদি অকল্পনীয় দুরত্বে অবস্থান করে এবং বায়ুমন্ডল বা সেই মহাকাশীয় অঞ্চলটির কোনোটিতেই অবস্থান না করে, তবুও রাতের বায়ুমন্ডলে কিংবা মহাকাশের সেই বিশাল অঞ্চলে নক্ষত্রগুলোর আলো ও সৌন্দর্য পর্যবেক্ষন করা যাবে, বায়ুমন্ডল অথবা মহাশুন্যের বিশাল অঞ্চলটি তবুও সেই নক্ষত্রগুলোর সৌন্দর্য ও আলো দ্বারা সজ্জিত ই গণ্য হবে। নিকটবর্তী আসমানকে নক্ষত্র দ্বারা সজ্জিত করার জন্য নক্ষত্রগুলোকে স্বশরীরে নিকটবর্তী আসমানে থাকতে হবে, এমন কোনো কথা নেই, নক্ষত্রগুলোকে নিকটবর্তি আসমান থেকে অকল্পনীয় দুরত্বের মধ্যে রেখেও সেই নক্ষত্রগুলো দ্বারা নিকটবর্তি আসমানকে সজ্জিত করা যায়। নক্ষত্র যত দুরেই অবস্থান করুক না কেন, নক্ষত্র কর্তৃক আকাশকে সজ্জিত করার দৃশ্য সর্বদা পরিলক্ষিত হবেই। অর্থাৎ এমনটা বলা গ্রহণযোগ্য যে নিকটবর্তি আসমানের বাহিরে নক্ষত্র আছে এবং নিকটবর্তি আসমানে কোনো নক্ষত্র নেই, নিকটবর্তি আসমানকে নক্ষত্র দ্বারা সজ্জিত করার অর্থ হলো নিকটবর্তি আসমান হতে অনেক দূরে অবস্থিত নক্ষত্রগুলো দ্বারা নিকটবর্তী আসমানকে সজ্জিত করা হয়েছে।

উপরে উল্লেখিত আমার এই কথাগুলোকে বিভিন্ন বড় বড় আলেমদের বক্তব্য প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে সমর্থন দেয়। নিম্নে এরকম কয়েকজন আলেমদের নাম উদাহরণস্বরুপ উল্লেখ্য করা হলো : …[36]

এক. আবু-হাফস ইবনু আদিল আদ-দিমাশক্বী
দুই.  মুহাম্মদ আল-খাতিব আশ-শিরবিনী
তিন. আবু-যাইদ আব্দুর-রহমান আছ-ছায়ালবী
চার. ফাখরুদ্দিন আবু-আব্দুল্লাহ আর-রাযী
পাচ.  বোরহানুদ্দিন ইব্রাহিম আল-বাক্বাঈ
ছয়.  মুহাম্মদ বিন আলি আশ-শাওক্বানী
সাত.  আব্দুর-রহমান বিন নাসির আস-সা'দী
আট. মুহাম্মদ ইবনু জুয্যাই আল-কালবী
নয়.  মুহাম্মদ আত-তহির ইবনু আশুর

এরকম আরো অনেকেই ……

(2.6)
ষষ্ঠ অভিযোগ: - "কোরআন অনুযায়ী আকাশমন্ডলী ও পৃথিবী স্থীর, এটা বৈজ্ঞানিকভাবে ভুল "।

জবাব : কোর'আনে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন :

إِنَّ اللَّهَ يُمْسِكُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ أَن تَزُولَا وَلَئِن زَالَتَا إِنْ أَمْسَكَهُمَا مِنْ أَحَدٍ مِّن بَعْدِهِ إِنَّهُ كَانَ حَلِيمًا غَفُورًا
অর্থাৎ : নিশ্চই আল্লাহ আকাশমন্ডলী ও ভুপৃষ্ঠকে ধরে রাখেন যাতে তারা স্থানচ্যুত না হয়।
……

এই আয়াতে ব্যবহৃত السَّمَاوَاتِ এর জন্য এক্ষেত্রে সবচেয়ে সামঞ্জস্যপুর্ণ মানানসই অর্থটি হবে 'সাত আসমানের সাতটি স্তর '। অর্থাৎ সাত আসমানের সাতটি স্তরকে আল্লাহ তায়ালা ধরে স্থীর রাখেন। আর সাত আসমানের সাতটি স্তর বর্তমানের বিজ্ঞানের নাগালের বাহিরের বিষয়। কাজেই এখানে বৈজ্ঞানিক অবৈজ্ঞানিক হয়ার কোনো প্রশ্ন আসেনা।

অপরদিকে যদি কথা আসে আল-আর্দের স্থীর হয়া প্রসংগে, সেক্ষেত্রে আল-আর্দ কথাটির দুটি অর্থ হয়,  একটা হচ্ছে সমগ্র পৃথিবী ও আরেকটা হচ্ছে পৃথিবীর পৃষ্ঠ তথা উপরিভাগ। কোরানের অন্যান্য বিভিন্ন আয়াতে 'পৃথিবীর পৃষ্ঠ' কে স্থীর বলা হয়েছে, যার অর্থ এক্ষেত্রে আল-আর্দের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত অর্থটি হবে 'পৃথিবীর পৃষ্ঠ'। অর্থাৎ পৃথিবীর পৃষ্ঠ স্থীর। পৃথিবীর পৃষ্ঠ স্থীর হয়ার বিষয়টি তখন বৈজ্ঞানিকভাবে সঠিক হবে যখন পৃথিবীতে অবস্থিত একজন মানুষকে প্রসংগবিন্দু ধরে এই প্রসংগবিন্দু সাপেক্ষে এমনটা বলা হবে ; আর কোরান সুন্নাহর অসংখ্যা বিষয় পরোক্ষভাবে এটা প্রমাণ করে যে কোরান সুন্নাহতে সবকিছু বর্ণিত হয়েছে মানুষ ও মানবইন্দ্রীয়সমুহকে ফ্রেইম অফ রেফারেন্স বা প্রসংগবিন্দু ধরে নিয়ে। যার অর্থ কোরান যদি বলে পৃথিবীর পৃষ্ঠ স্থীর তাহলে তা কোনো অবৈজ্ঞানিক বিষয় হবেনা।

এখন কেও এসে বলতে পারে : " এরমানেকি সাত আসমানের সাতটি স্তর পৃথিবীর উপর পতিত হতে পারে? এই দেখো!  এই আয়াতের ব্যাখ্যায় অমুক মুফাসসির অমুক গ্রন্থে বলেছেন যে এরদ্বারা বোঝানো হয়েছে যে আল্লাহ আকাশকে ধরে স্থীর রাখেন যাতে তা যমিনের উপর পতিত না হয় "

এর প্রতিউত্তর নিম্নরুপ :

একশ্রেণীর আলেম উক্ত আয়াতকে সুরা আল-হাজ্জের আয়াত নং  65 দ্বারা ব্যাখ্যা করে এমন ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তবে সব মুফাসসির এমনটা করেন নি, এমনকি এমনটাত অধিকাংশ মুফাসসিরদেরও মত নয়, এরকম ব্যাখ্যা বাদ দিয়েও উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যা করা যায়, বিপুল সংখ্যাক মুফাসসির এমন রয়েছেন যারা আলোচ্য আয়াতটির ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে সুরা আল-হাজ্জের সেই আয়াতটিকে এনে এমন ব্যাখ্যা দেন নি। কাজেই আলোচ্য আয়াতের ক্ষেত্রে এমনটা হয়া জরুরি না যে একে সুরা আল-হাজ্জের সেই আয়াতটি দিয়ে ব্যাখ্যা করা লাগবে।

সাহাবি ইবনু মাসউদ (রা) এই আয়াতটিকে পরোক্ষভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। এই আয়াত হতে তিনি যা বুঝেছেন, সেই বুঝের সারমর্ম হলো এই যে সাত আসমানের স্তরগুলো স্থির হয়ে আছে [38]। যেখানে সাহাবি ইবনু মাসউদ (রা) আলোচ্য আয়াত হতে প্রাপ্ত এতটুকু বিষয়কেই ব্যাখ্যা হিসেবে যথেষ্ট মনে করেছেন, সেখানে এমনটা ভাবার কোনো সুযোগ নেই যে আলোচ্য আয়াতের প্রকৃত ব্যাখ্যা বা সম্পুর্ণ ব্যাখ্যা সুরা আল-হাজ্জের সেই আয়াতটিতে আছে।

(2.7)
সপ্তম অভিযোগ :- "কোরানে বলা হয়েছে যে আল্লাহ আকাশকে ধরে রাখেন যাতে তা পৃথিবীর উপর পতিত না হয়। এটা একটা অবৈজ্ঞানিক বিষয় "।

জবাব : সুরা আল-হাজ্জ এর আয়াত 65 এ বলা হয়েছে 
وَيُمْسِكُ السَّمَاء أَن تَقَعَ عَلَى الْأَرْضِ إِلَّا بِإِذْنِهِ

অর্থ : এবং তিনি আকাশকে ধরে রাখেন যাতে তা ভুপৃষ্ঠে/পৃথিবীতে তাঁর (আল্লাহর) অনুমতি ব্যাতিত পতিত না হয়।

এ লেখাটির শুরুর দিকে আকাশের অর্থের ব্যাপারে যে বিস্তারিত লম্বা আলোচনা গত হয়েছে, সেই আলোচনার উপর ভিত্তি করে বলা যায় যে আকাশ দ্বারা মহাকাশের বিভিন্ন উপাদান যেমন : গ্রহ, উপগ্রহ, উল্কাপিন্ড, ইত্যাদি এধরনের জিনিসও উদ্দেশ্য হতে পারে।

বিংশ শতাব্দীর একজন বড়মাপের মুফাসসির 'মুহাম্মদ আত-তাহির ইবনু আশুর ' সহ সাম্প্রতিক কালের অন্যান্য বিভিন্ন মুফাসসির যেমন : আহমদ হাতিবাহ, মুস্তফা আল-মারাগ্বী, ওহবাহ আয-যুহাইলী, মাহমুদ হিজাযি,  আল-আযহারের মাজমায়ুল বুহুসের উলামাগণ আলোচ্য আয়াতে উল্লেখিত السَّمَاء এর  ব্যাখ্যা করেছেন 'বিভিন্ন মহাকাশীয় বস্তু' [39]।

অর্থাৎ এই আয়াতে বোঝানো হয়েছে যে আল্লাহ বিভিন্ন মহাকাশীয় বস্তুকে (যেমন : গ্রহ, উপগ্রহ) ধরে রাখেন, যাতে করে তারা আল্লাহর অনুমতি ব্যাতিত পৃথিবীর বা ভুপৃষ্ঠের উপর পতিত হতে না পারে।

(2.8)
অষ্টম অভিযোগ :- " কোরান অনুযায়ী আকাশ হচ্ছে একটা শক্ত ঢাকনার মত বস্তু, যা হতে টুকরা বা খন্ড ভেঙ্গে ভুপৃষ্ঠের উপর অবস্থিত মানুষদের উপর পতিত হতে পারে"

জবাব :

কোর'আনের চারটি আয়াতকে কেন্দ্র করে এমনটা দাবি করা হয়। সেই চারটি আয়াত উল্লেখ্যকরাপুর্বক অভিযোগটির জবাব দেয়া হলো।

আয়াতগুলো নিম্নরুপ :-- …[40]

প্রথম আয়াত ;
أَوْ تُسْقِطَ ٱلسَّمَآءَ كَمَا زَعَمْتَ عَلَيْنَا كِسَفًا
"অথবা তুমি আকাশকে টুকরো টুকরো করে আমাদের উপর ফেলবে যেমনটা তুমি বলেছ "

দ্বিতীয় আয়াত ;
وَإِن يَرَوْا۟ كِسْفًا مِّنَ ٱلسَّمَآءِ سَاقِطًا يَقُولُوا۟ سَحَابٌ مَّرْكُومٌ
আকাশের কোন খন্ড ভেঙ্গে পড়তে দেখলে তারা বলত- ‘এটা তো পুঞ্জীভূত মেঘ।

তৃতীয় আয়াত ;
فَأَسْقِطْ عَلَيْنَا كِسَفًا مِّنَ ٱلسَّمَآءِ إِن كُنتَ مِنَ ٱلصَّـٰدِقِينَ
অতএব, তুমি যদি সত্যবাদী হও, তবে আসমান থেকে এক টুকরো আমাদের উপর ফেলে দাও’।

চতুর্থ আয়াত :
إِن نَّشَأْ نَخْسِفْ بِهِمُ ٱلْأَرْضَ أَوْ نُسْقِطْ عَلَيْهِمْ كِسَفًا مِّنَ ٱلسَّمَآءِ ۚ
যদি আমি (আল্লাহ) ইচ্ছা করি তাহলে তাদেরকে সহ ভূমি ধসিয়ে দেব অথবা আসমান থেকে এক খন্ড তাদের উপর নিপতিত করব

প্রথম আয়াতটিতে যদিও ব্যাহ্যিকভাবে মনে হচ্ছে যে আকাশকে টুকরো টুকরো করার কথা বলা হয়েছে, তবে প্রকৃতপক্ষে এখানে বোঝানো হয়েছে 'আকাশ থেকে খন্ড' পতিত হয়া, আকাশ টুকরো টুকরো হয়ে পতিত হয়ার কথা এখানে বোঝানো হয়নি। এই আয়াতটিকে অপর তিনটি আয়াত দ্বারা ব্যাখ্যা করতে হবে ও বুঝতে হবে, কেননা এই আয়াতটি ও বাকি তিনটি আয়াত মুলত একই প্রসঙ্গের, আর এই আয়াতকে বাকি আয়াতগুলোর দ্বারা ব্যাখ্যা করলে উক্ত আয়াত দ্বারা যা বোঝানো উদ্দেশ্য হবে তা হচ্ছে 'আকাশ থেকে খন্ড' পতিত হয়া, আকাশ নিজেই টুকরো টুকরো হয়ে পতিত হয়া উদ্দেশ্য হবেনা এক্ষেত্রে। আবু-হাফস, মুকাতিল, আবুস-সউদ, আবুল-বারাকাত, ইবনু আশুর, ইয়াহইয়া, ইবনু জুয্যাই, আশ-শাওকানী সহ অন্যান্য আরো অনেক মুফাসসির এক্ষেত্রে একাজটা করেছেন ; অর্থাৎ এই প্রথম আয়াতটিকে বাকি তিনটি আয়াত দ্বারা ব্যাখ্যা করে বুঝাতে চেয়েছেন যে বাকি তিনটি আয়াতে যা বলা হয়েছে, এই আয়াতে সেটা বোঝানোই উদ্দেশ্য। আর বাকি তিনটি আয়াতে 'আকাশ থেকে খন্ড' পতিত হয়ার কথা বলা হয়েছে, আকাশ নিজেই খন্ড খন্ড হয়ে পতিত হয়ার কথা সেসব আয়াতে বলা হয়নি [41]। আর যেহেতু উক্ত আয়াতের প্রসঙ্গের অন্তর্ভুক্ত হিসেবেই অন্য তিনটি আয়াতের প্রসঙ্গগুলো বিদ্যমান আছে তথা চারটির সবকটির প্রসঙ্গ একই ; সেহেতু উক্ত আয়াতকে বাকি তিনটি আয়াতের দ্বারা ব্যাখ্যা করাটাই হবে সর্বশ্রেষ্ঠ ও সবচেয়ে অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত ব্যাখ্যা [42], অর্থাৎ এক্ষেত্রে অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত ব্যাখ্যা হলো এটাই যে এখানে বোঝানো হয়েছে 'আকাশ থেকে খন্ড' পতিত হয়া, আকাশ টুকরো টুকরো হয়ে পতিত হয়ার কথা এখানে বোঝানো হয়নি।

এবার আসা যাক বাকি আয়াতগুলোর দিকে। প্রথম আয়াতসহ বাকি তিনটি আয়াতে যা বোঝানো হয়েছে তা হচ্ছে كسف من السماء 'আকাশ থেকে খন্ড' পতিত হয়া।  বাংলা অনুবাদে 'আকাশের খন্ড ' বলা হলেও সবচেয়ে শাব্দিক ও সামঞ্জস্যপুর্ণ অনুবাদ হবে 'আকাশ থেকে খন্ড '। এখন আকাশ থেকে খন্ড পতিত হয়ার ব্যাপারটা থেকে কোনোভাবেই এটা প্রমাণিত হয়না যে আকাশ শক্ত এমনকিছু যার থেকে টুকরা ভেংগে এসে পতিত হতে পারে। কেননা 'আকাশ থেকে খন্ড পতিত হয়া' কে এইভাবেও ব্যাখ্যা করা যায় যে এরদ্বারা কোনো মহাকাশীয় বস্তু বা কোনো মহাকাশীয় বস্তুর খন্ড পতিত হয়া উদ্দেশ্য, তথা অনেকটা উল্কাজাতীয় বিভিন্ন মহাকাশীয় পাথরখন্ড পৃথিবীতে পতিত হয়ার মতো। আর অনেক মুফাসসির ব্যাপারটাকে এভাবে ব্যাখ্যা করেছেনও, উদাহরণস্বপরুপ বলা যায় ইবনু আশুরের নাম, যিনি কিনা খুব সুস্পষ্টভাবেই আকাশ হতে খন্ড পতিত হয়ার বিষয়টিকে এভাবে ব্যাখ্যা করেছেন[43]।

(2.9)
নবম অভিযোগ :- "কোরান অনুযায়ী আকাশে কোনো ফাটল বা ছিদ্র নেই, যদি আকাশ কোনো শক্ত বা কঠিন পদার্থের জিনিস নাই হয়ে থাকে, তাহলে এর ফাটল থাকা বা না থাকার প্রশ্ন আসেইবা কিভাবে?"

জবাব : - আকাশের ফাটল বা ছিদ্র না থাকার ব্যাপারে কোরানে মোট দুইটি মূল আয়াত রয়েছে। সেই দুটি আয়াত উল্লেখ্য করে সেগুলোর ব্যাপারে নিম্নে আলোচনা করা হলো।

প্রথম আয়াত প্রসঙ্গে ;

সুরা 67 এর আয়াত 3 এ বলা হয়েছে

الذي خلق سبع سماوات طباقا ما تری في خلق الرحمان من تفاوت فارجع البصر هل تری من فطور

'তিনি সাত আসমান সৃষ্টি করেছেন স্তরে স্তরে, রহমানের সৃষ্টিতে তুমি কোনো ক্রুটি দেখতে পাবেনা, নিজের দৃষ্টি ফিরাও, কোনো ফুতুর দেখতে পাও কি? '

এখানে ব্যবহৃত فطور কথাটার সরল বাংলায় অনুবাদ হয় 'ফাটল ' বা 'ছিদ্র'। কাজেই এখানে বাংলা অনুবাদে 'ভুল' আছে, এমনটা বলা সঠিক হবেনা। তবে আরবি ও বাংলার মধ্যকার জটিল সম্পর্কের ফলাফল হিসেবে এই অনুবাদটার 'একটা দুর্বলতা ' বা 'সীমাবদ্ধতা আছে ', তা কি? সেটা সামনের আলোচনাতেই বুঝতে পারবেন।

সবকিছু বাদ দিয়ে তর্কের খাতিরে কিছুক্ষণের জন্য ধরে নিচ্ছি যে আলোচ্য আয়াতটিতে আমাদের মাথার উপরে আমরা যেই নীল আকাশ দেখতে পাই, সেই নীল আকাশে কোনোরুপ ফাটল না থাকার কথা বলা হয়েছে। এরমানেকি এই?  যে আমাদের মাথার উপরের নীল আকাশটা শক্ত কোনো জিনিস? 

মোটেও না! কেননা এখানে ব্যবহৃত فطور শব্দটি হচ্ছে فطر এর বহুবচন, আর আরবিতে فطر শব্দ দ্বারা 'উন্মুক্ততা' বোঝানো হয় [44]। আরো পরিষ্কারভাবে বললে এদ্বারা কোনো ব্যবধানের মধ্যে কিংবা কোনো জিনিসের মধ্যে  উন্মুক্ততা বোঝানো হয়। আর যেহেতু ফাটল ও ছিদ্র এসব শব্দ বিভিন্ন জিনিসের মধ্যকার 'উন্মুক্ততা' বোঝানোর জন্য ব্যবহৃত হয়, সেহেতু فطر এর অনুবাদ 'ছিদ্র' বা 'ফাটল' করা হয়। বাংলায় 'ফাটল ' বা 'ছিদ্র' এই শব্দগুলো সাধারনত শুধুমাত্র কঠিন পদার্থের জন্য ব্যবহৃত হলেও আরবি فطر এর ক্ষেত্রে এমন কোনো শর্ত নেই যে সেটাকে শক্ত কোনো জিনিসের ক্ষেত্রে ব্যবহার হতে হবে।

এই আয়াতে বলা হয়েছে আমাদের উপরের নীল আকাশে কোনো ফাতর বা ফুতুর নেই, তথা নীল আকাশে কোনো উন্মুক্ততা নেই, আর এটা একটা বাস্তবসম্মত কথা, কারণ নীল আকাশে আসলেই কোনো উন্মুক্ততা নেই, বায়ুমন্ডল আকাশে কোনো উন্মুক্ততা রাখেনি।যদি উন্মোক্ততা থাকতো, তাহলে তা পৃথিবীর জীবনের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলত।

আর উন্মুক্ততার ক্ষেত্রে কোনো পদার্থ কঠিন হলো না বায়বীয় হলো, সেটা কোনো গুরত্ব বহন করেনা, উন্মুক্ততা থাকা বা না থাকার প্রশ্ন বায়বীয় আবরণের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হতে পারে, এর জন্য আবরণটিকে শক্ত কিছু হয়ার দরকার নেই। কাজেই আকাশে উন্মুক্ততা নেই, এমনটা বলার দ্বারা মোটেও প্রমাণিত হয়না বা ইংগিত পাওয়া যায়না যে নীল আকাশ শক্ত কোনোকিছু।

এবার মুল আলোচনায় আসা যাক।

এই আয়াতটিতে في خلق الرحمان (রহমানের সৃষ্টিতে) বলতে সাধারনভাবে 'আল্লাহর সকল সৃষ্টি ' উদ্দেশ্য, নাকি 'সাত আসমান' উদ্দেশ্য সেব্যাপারে মতভেদ আছে। একদল আলেম এক্ষেত্রে সাধারন অর্থ অনুসারে বলেছেন যে 'রহমানের সৃষ্টিতে' বলতে সকল সৃষ্টিই উদ্দেশ্য,[45] পক্ষান্তরে আরেকদল আলেম বলেছেন যে এখানে নির্দিষ্টভাবে খাসভাবে 'সাত আসমান উদ্দেশ্য '। যদি 'রহমানের সৃষ্টি' বলতে সকল সৃষ্টিই উদ্দেশ্য হয়, তাহলে ফুতুর না থাকার বিষয়টি সকল সৃষ্টির জন্যই প্রযোজ্য হবে, আবার যদি সাত আসমান উদ্দেশ্য হয় তাহলে তা মাথার উপরের নীল আকাশের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে। তবে মুলনিতী অনুযায়ী, এক্ষেত্রে অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত অধিক সঠিক মতটি হচ্ছে 'সকল সৃষ্টি' উদ্দেশ্য হয়ার মতটি। [46]

এবার ফুতুরের ব্যাপারে দুটি মৌলিক মত রয়েছে। প্রথম মতটি হচ্ছে এরদ্বারা 'ক্রুটি, ভুল, ভারসম্যহীনতা, সমস্যা ' বা এই ধরনের অর্থ উদ্দেশ্য ; এবং দ্বিতীয় মতটি হচ্ছে যে এরদ্বারা 'ফাটল ' বা 'ছিদ্র ' বা এধরনের অর্থ উদ্দেশ্য [47]। এদুইটি মতকে তিনভাবে গ্রহণ করা যায় :

(১) শুধুমাত্র প্রথম মতটি
(২) শুধুমাত্র দ্বিতীয় মতটি
(৩) উভয় মতকেই একত্রে [48]

এদুইটি মত একে অপরের খুব কাছাকাছি ও প্রায় সমার্থক, এবং বহু আলেম উভয়কেই একইসাথে গ্রহণ করেছেন। কাজেই এই মতগুলো থেকে আলাদা আলাদাভাবে গ্রহণ না করে উভয় মতকেই একইসাথে গ্রহণ করে আলোচনা করা হবে।

যদি ধরে নেই যে এক্ষেত্রে সকল সৃষ্টি উদ্দেশ্য হয়ার মতটিই সঠিক, তাহলে আয়াতের অর্থ দারাবে যে আল্লাহর সৃষ্টিতে কোনো ফাতর বা ফুতুর তথা 'ক্রুটি ও ফাটল' নেই ; উল্লেখ্য যে আত-তাবারী فارجع البصر هل تری من فطور এর ব্যাখ্যায় হুবুহু এই ব্যাখ্যাই দিয়েছেন, তিনিও আল্লাহর সকল সৃষ্টি উদ্দেশ্য হয়ার মতটিকে সঠিক ধরেছেন এবং ফুতুরের ব্যাখ্যায় প্রচলিত উভয় মতকে একত্রে একইসাথে গ্রহন করেছেন  [49]।

এহিসেবে এই আয়াতটিতে অউদো আকাশের ফুতুর বা ফাতর থাকা না থাকার কোনো প্রসঙ্গই নেই, এই আয়াতে আকাশে ফাতর বা ফুতুর নেই এমন কিছু বলাই হয়নি। বরং এই আয়াতটিতে 'আল্লাহর সকল সৃষ্টি' এর ব্যাপারে বলা হচ্ছে যে আল্লাহর সৃষ্টিতে কোনো ফাতর বা ফুতুর অর্থাৎ ফাটল ও ক্রুটি নেই। আর যেহেতু আল্লাহর সকল সৃষ্টি উদ্দেশ্য হয়ার মতটি অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত, সেহেতু আত-তাবারীর এই ব্যাখ্যাটিই অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত ও অধিক সঠিক।

এখন প্রশ্ন আসতে পারে যে, আল্লাহর অনেক সৃষ্টিতে তো ফাটল দেখা যায়, তাহলে এমনটা কিভাবে হতে পারে যে আল্লাহর সকল সৃষ্টিতে ক্রুটির পাশাপাশি 'ফাটল' ও নেই?  এই প্রশ্নের জবাব আল্লাহর সমগ্র সৃষ্টি উদ্দেশ্য হয়ার মতের পক্ষের আলেমরা দিয়ে রেখেছেন, উনাদের সেই জবাবের সারমর্ম হলো অনেকটা এরকম যে : ফাটল না থাকা বলতে বোঝানো হয়েছে যে যেসব সৃষ্টিতে ফাটল থাকার কথা নয় বা ফাটল থাকলে সৃষ্টিগুলো ক্রুটিপুর্ণ হয়ে যেতো, সেসব সৃষ্টিতে কোনো ফাটল নেই, যেসব সৃষ্টির জন্য ফাটল থাকাটা স্বাভাবিক ও প্রাকৃতিক ও ক্রুটিতৈরিকারী নয়, সেসব সৃষ্টিতে ফাটল থাকতেই পারে। [50]

অপরদিকে, যদি ধরে নেই যে في خلق الرحمان দ্বারা সাত আসমান উদ্দেশ্য, সেক্ষেত্রে এই আয়াতের অর্থ দারাবে অনেকটা এই যে আমাদের মাথার উপরের নীল আকাশে কোনো 'ক্রুটি' ও 'ফাটল' নেই ; উল্লেখ্য, একদল মুফাসসির হুবুহু এরকম ব্যাখ্যাই দিয়েছেন। মাথার উপরের নীল আকাশে কোনো ক্রুটি না থাকার ব্যাপারটাতে কোনো সমস্যা নাই, কিন্ত মুল ঝামেলা বাধে 'ফাটল' না থাকার প্রসঙ্গে। এখন নীল আকাশে ফাটল না থাকার দ্বারা কি প্রমাণিত হয় যে নীল আকাশ শক্ত কোনোকিছু? মুল আলোচনা শুরুর পুর্বে তর্কের খাতিরে ধরে নিয়ে এব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা পুর্বেই গত হয়েছে, তাই এব্যাপারে আবার নতুনভাবে এখানে আলোচনা করার কোনো দরকার নেই।

দ্বিতীয় আয়াত প্রসঙ্গে ;

সুরা 50 এর আয়াত 6 এ আল্লাহ বলেন

أَفَلَمْ يَنظُرُوٓا۟ إِلَى ٱلسَّمَآءِ فَوْقَهُمْ كَيْفَ بَنَيْنَـٰهَا وَزَيَّنَّـٰهَا و مَا لَهٰا مِن فروج

"তারাকি দেখেনা তাদের উপরের আকাশের দিকে, কিভাবে আমি তা সৃষ্টি করেছি ও তাকে সজ্জিত করেছি, এবং এতে কোনো ফাটল নেই "

আয়াতটির "فروج" শব্দের অর্থ হলো "ফাটল "। সকল মুফাসসির এব্যাপারে একমত হয়েছেন যে এর অর্থ "ফাটল " [51]

এই আয়াতের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা পুর্বে আলোচিত প্রথম আয়াতটির ফাতর বা ফুতুর শব্দটির মতই। এখানে فروج হলো فرج এর বহুবচন। আর فرج এর মুল সংজ্ঞা হচ্ছে যে এরদ্বারা 'উন্মুক্ততা ' বোঝায় [52]। আরো পরিষ্কারভাবে বললে কোনো ব্যবধান বা জিনিসের মাঝে উন্মুক্ততা বোঝায়।  যেহেতু উন্মুক্ততা বোঝানোর জন্য বাংলায় 'ফাটল' বা 'ছিদ্র' শব্দদুটি ব্যবহার করা হয়ে থাকে, সেহেতু এর সরল বাংলা অনুবাদ 'ফাটল' বা 'ছিদ্র' করা হয়।বাংলায় 'ফাটল ' বা 'ছিদ্র' এই শব্দগুলো সাধারনত শুধুমাত্র কঠিন পদার্থের জন্য ব্যবহৃত হলেও আরবি فرج এর ক্ষেত্রে এমন কোনো শর্ত নেই যে সেটাকে শক্ত কোনো জিনিসের ক্ষেত্রে ব্যবহার হতে হবে।

অর্থাৎ উক্ত আয়াতে বলা হচ্ছে যে আমাদের মাথার উপরের আকাশে কোনো উন্মুক্ততা নেই । আর এটা বাস্তব সম্মত একটা কথা, কারণ আসলেই বায়ুমন্ডলে কোনো উন্মুক্ততা নেই, যদি থাকতো, তাহলে পৃথিবীতে জীবন হুমকির মুখে পড়তো। আর উন্মুক্ততার ক্ষেত্রে কোনো পদার্থ কঠিন হলো না বায়বীয় হলো, সেটা কোনো গুরত্ব বহন করেনা, উন্মুক্ততা থাকা বা না থাকার প্রশ্ন বায়বীয় আবরণের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হতে পারে, এর জন্য আবরণটিকে শক্ত কিছু হয়ার দরকার নেই। কাজেই আকাশে উন্মুক্ততা নেই, এমনটা বলার দ্বারা মোটেও প্রমাণিত হয়না বা ইংগিত পাওয়া যায়না যে  আকাশ শক্ত কোনোকিছু।

(2.10)
দশম অভিযোগ :- "কোরান ও হাদিস অনুযায়ী আকাশের অনেক দরজা আছে, এবং আকাশের দরজা দিয়ে নাকি বৃষ্টিপাতও হয় "

জবাব :-

প্রথমে আকাশের দরজা দিয়ে বৃষ্টিপাত হয়ার ব্যাপারে আলোচনা করা হবে এবং তারপর আকাশের দরজা প্রসঙ্গে আলোচনা করা হবে।

সুরা 54 এর আয়াত 11 এ বলা হয়েছে যে :
فَفَتَحْنَآ أَبْوَٰبَ ٱلسَّمَآءِ بِمَآءٍ مُّنْهَمِرٍ
"এবং আমি (আল্লাহ) আকাশসমুহের দরজা প্রবল বৃষ্টি দ্বারা খুলে দিলাম"

আয়াতটি নুহ (আ) এর সময়কার মহাপ্রলয়ের সাথে সম্পর্কিত। এই আয়াতটিকে কেন্দ্র করেই আকাশের দরজা দিয়ে বৃষ্টির পানি পতিত হয়ার অভিযোগটি করা হয়।

এই অভিযোগের জবাবস্বরুপ ও উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যাস্বরুপ জুমহুর মুফাসসিরগণ বলেছেন যে ;

"এখানে প্রবল বৃষ্টিপাতের দ্বারা আকাশের দরজাসমুহ খোলা সক্রান্ত বাক্যটি রুপকার্থে উপমা-অর্থে এসেছে। শাব্দিক অর্থে নয়।প্রবল বৃষ্টি পড়তে দেখলে মনে হয় যেন কেও আকাশ থেকে দরজা খুলে প্রবল বৃষ্টি পতিত করছে। আর এথেকেই উক্ত আয়াতে উপমা বা রুপক হিসেবে বলা হয়েছে যে তিনি (আল্লাহ) প্রবল বৃষ্টিপাতের দ্বারা আকাশের দরজাসমুহ খুলেছেন। এখানে শাব্দিকভাবে বাস্তবিকঅর্থে এটা বুঝানো হয়নি যে বৃষ্টিপাতের জন্য আকাশে দরজা আছে বা আকাশের দরজা দিয়ে বৃষ্টিপাত  হয় "_[53]

বা আরো কম কথায় সংক্ষেপে বললে বলা যায় যে এই আয়াতটিতে বর্ণিত প্রবল বৃষ্টিপাতের দ্বারা আকাশের দরজাসমুহ খোলার ব্যাপারটি 'রুপক-অর্থের' বা 'উপমা-অর্থের '।

এই আয়াতটির সাথে সম্পর্কিত আলী (রা) এর একটি বক্তব্য আছে, অনেকে না বোঝে উনার এই বক্তব্যকে জুমহুর মুফাসসিরদের ব্যাখ্যাটির বিরুদ্ধে দাড় করাতে পারে।

ইমাম আল-বুখারি আলি (রা) হতে বর্ননা করেছেন : আবুত তুফাইল (রা) হতে বর্নিত : ইবনুল কাওয়া আলিকে (রা)"মাজাররাহ " সম্পর্কে জিগ্যাস করলেন। তিনি (আলি) বললেন : সেটা হলো মহাশুন্যের একস্থান হতে অপর স্থানে যাওয়ার পথ, এবং এখান হতেই আকাশের দরজাকে প্রবল বৃষ্টিপাতের মাধ্যমে খোলে দেয়া হয়েছিল [54]

দিয়াউদ্দিন আল-মাকদেসি আলি (রা) হতে বর্ননা করেছেন যে : (আব্দুল্লাহ বিন আল-কাওয়া) বললেন : তাহলে "মাজাররাহ" কি? (আলি) বললেন মহাশুন্যের একস্থান হতে আরেক স্থানে যাওয়ার পথ, এবং এখান থেকেই কওমে নুহের উপর মহাপ্রলয় আসার সময় আকাশের দরজাসমুহ প্রবল বৃষ্টিপাতের দ্বারা খুলে দেয়া হয়েছিল [55]

আলি (রা) উক্ত মহাপ্রলয়ের পানির আসার পথ সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন, যে এটি একটি পোর্টালের বা প্রবেশপথের সাহায্যে পৃথিবীতে এসেছিল। তিনি "আকাশের দরজা খুলে বৃষ্টি পতিত হয়া " সম্পর্কে কোনো ব্যাখ্যা করেন নি, কোনো মন্তব্য করেন নি। সুতরাং উনার এই বক্তব্য ও জুমহুর মুফাসসিরদের বক্তব্যের মাঝে কোনো বিরোধ নেই।

এবার আসা যাক 'আকাশের দরজা ' প্রসঙ্গে। কোরান ও হাদিসের অগণিত স্থানে আকাশের দরজার কথা বিভিন্নভাবে বর্ণনা করা হয়েছে, অর্থাৎ ইসলাম অনুযায়ী আকাশে অনেকগুলো দরজা রয়েছে। এখন প্রশ্ন হলো এই যে, 'আকাশের দরজা ' আসলে কি? এর অর্থ বা ব্যাখ্যা কি?  ইসলামে আকাশের বাব বা দরজা বলতে বোঝানো হয় 'এমন একটা মাধ্যম বা পথ যা আকাশের এক অঞ্চলকে আরেক অঞ্চলের সহিত যুক্ত করে ' [56], আর এটাই 'আকাশের দরজা' কথাটির ভাষাগত সংজ্ঞা [56]। স্পষ্টতই, "আকাশের দরজা " এর ভাষাগত সংজ্ঞা আর সাধারন দরজার ভাষাগত সংজ্ঞার মাঝে পার্থক্য আছে, কাজেই আকাশের দরজাকে আমাদের চেনাপরিচিত দরজার সহিত তুলনা দেয়া ভিত্তিহীন।আকাশের দরজার কৈফিয়ত ও ধরন-প্রকৃতি কেমন তা ইলমুল-গায়েবের অন্তর্ভুক্ত বিষয়, এব্যাপারে আল্লাহ ছাড়া অন্য কেওই কোনোকিছু জানেনা।

(2.11)
একাদশ অভিযোগ :- "কোরান অনুযায়ী আকাশের আবরণকে কেয়ামতের সময় অপসারিত করা হবে, যা অবৈজ্ঞানিক " অথবা "কোরান অনুযায়ী আকাশকে অপসারিত করা হবে এবং এটা একটা অবৈজ্ঞানিক কথা "।

জবাব :

সুরা 81 এর আয়াত 11 এ বলা হয়েছে ;

وَإِذَا ٱلسَّمَآءُ كُشِطَتْ
"এবং যখন আকাশকে কাশত করা হবে "

এই আয়াতের বাংলা অনুবাদে কিছু স্থানে বলা হয়েছে 'যখন আকাশের আবরণ অপসারিত করা হবে ', এইটা সম্পুর্ণ ভুল ও ভিত্তিহীন। এর অনুবাদ হিসেবে  "আকাশকে অপসারিত করা হবে " বলাটা সঠিক হলেও 'আকাশের আবরণ অপসারিত করা হবে' বলাটা ভুল ও ভিত্তিহীন।

এবার মুল আলোচনায় আসা যাক। এই আয়াতের আকাশকে 'কাশত' করা এর ব্যাখ্যা নিয়ে মুফাসসিরদের মাঝে তিনটি মত রয়েছে, যথা : …[57]

১. আকাশকে সড়িয়ে নেয়া হবে।
২. আকাশকে অন্ধকার আলোহীন করে দেয়া হবে।
৩.  আকাশকে অবিস্তৃত অপ্রসারিত করে তার আয়তন কমিয়ে আনা হবে।

যদি প্রথম মতটিকে সঠিক ধরি, সেক্ষেত্রে বলা যায় যে এরদ্বারা যা বোঝানো হয়েছে তা হলো এই যে কেয়ামতের সময় বায়ুমন্ডলের কিছু স্তর সড়িয়ে নেয়া হবে বা সমগ্র বায়ুমন্ডলকেই সড়িয়ে নেয়া হবে।

যদি দ্বিতীয় মতটিকে সঠিক ধরি, সেক্ষেত্রে ব্যাপারটা আরো সোজা, সেক্ষেত্রে আয়াতের মর্ম দারাবে অনেকটা এরকম যে কেয়ামতের সময় আকাশ অন্ধকার হয়ে যাবে।

যদি তৃতীয় মতটিকে সঠিক ধরি, সেক্ষেত্রে বলা যায় যে এরদ্বারা যা বোঝানো হয়েছে তা হলো এই যে পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের আয়তন ছোট হয়ে যাবে ; অথবা হতে পারে এখানে আকাশ বলতে সমগ্র মহাশুন্যই উদ্দেশ্য, যার অর্থ সমগ্র মহাশুন্য অবিস্তৃত অপ্রসারিত হয়ে তার আয়তন কমে যাবে।

অর্থাৎ যেই মতই ধরি না কেন, সবক্ষেত্রেই আয়াতটির জন্য বিজ্ঞানসম্মত সাম্ভাব্য ব্যাখ্যা থাকে। কাজেই এই আয়াত অবৈজ্ঞানিক হয়ার চেয়ে বহুত দূরে অবস্থান করে।

(2.12)
দ্বাদশ অভিযোগ :- "কোরান অনুযায়ী আকাশ কাগজের মত বস্তু, যাকে 'ভাজ' করা যায় বা 'গুটিয়ে নেয়া' যায় "

জবাব :

কিছু আয়াত ও হাদিস দেখিয়ে এমনটা দাবি করা হয়ে থাকে। সেই আয়াত ও হাদিস গুলো উল্লেখ্য করা পুর্বক জবাব প্রদান করা হলো।

সুরা 21 এর আয়াত 104 এ বলা হয়েছে ;

يوم نطوی السماء كطي السجل للكتب
"সেদিন আমি (আল্লাহ) আকাশকে লেখার কাগজের মত অবিস্তৃত করব"

এই আয়াতটার অনুবাদে نطوی এর অনুবাদ করা হয়েছে 'ভাজ করব', যদিও এটা ভুল অনুবাদ না, তবে এই অনুবাদের কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। সেই সীমাবদ্ধতা কি তা সামনের আলোচনায় বুঝতে পারবেন।

প্রথমত, এখানে আল্লাহ বলেছেন يوم نطوی (সেদিন আমি ত্বওই করব), এখানে ব্যবহৃত ক্রিয়া نطوی এসেছে 'طي' বা 'طوي' ধাতু থেকে, طي বা طوي মানে হলো 'প্রসারণের বিপরীত ক্রিয়া' বা সরল ভাষায় বললে 'আয়তন কমানো ' [58]। অর্থাৎ আল্লাহ এখানে طوي বলতে প্রকৃতপক্ষে যা বুঝিয়েছেন তা হচ্ছে আকাশের 'আয়তন কমানো', যেহেতু ভাজ করলে ভাজকৃত বস্তুর সহিত প্রসারণের বিপরীত ক্রিয়া সংঘটিত হয় ও মনে হয় যেন সেটার আয়তন একটু কমে গেছে, সেহেতু ত্বওই এর অর্থ করা হয় 'ভাজ করা '। তবে طوي এর প্রকৃত অর্থ 'ভাজ করা' বিষয়টির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয় বরং এরচেয়েও অনেক বিস্তৃত, যেকোনোভাবে প্রসারণের বিপরীত ক্রিয়া সংঘটিত করলে বা আয়তন কমালেই طوي হয়, এর জন্য 'ভাজ করা' কোনো শর্ত না, ভাজ করা ছাড়াও طوي হতে পারে।

এবার আসা যাক আকাশকে কাগজের সহিত তুলনা করার ব্যাপারে। এই আয়াতে আসলে আকাশের সহিত কাগজের কোনো তুলনা করা হয়নি, বরং এখানে শুধুমাত্র নির্দিষ্টভাবে আকাশের ত্বওই হয়ার বিষয়টির সহিত কাগজের ত্বওই হয়ার বিষয়টির মাঝে তুলনা করে উপমা দেয়া হয়েছে, এখানে উপমা দ্বারা শুধুমাত্র আকাশের ত্বওই হয়া ও কাগজের ত্বওই হয়ার সাদৃশ্যতা উদ্দেশ্য, আকাশ ও কাগজের গঠন-প্রকৃতি এই উপমার বাইরের বিষয়। [59]। হাত এবং 'হাত দুর্বল হয়ে যাওয়া' যেমন এক বিষয় না, একইভাবে আকাশ ও 'আকাশের ত্বওই হয়া ' এক বিষয়না, এবং একইভাবে 'কাগজ' ও 'কাগজের ত্বওই হয়া' এক বিষয় না। কাজেই আকাশের ও কাগজের ত্বওই হয়ার ব্যাপারের মাঝে তুলনা করে উপমা দেয়ার দ্বারা এটা সাব্যস্ত হয়না যে আকাশা কাগজের কত কোনোকিছু, কারণ এখানে আকাশ ও কাগজকে তুলনা করা হয়নি, বরং তাদের ত্বওই হয়ার ব্যাপারটিকে তুলনা করা হয়েছে।

যদি বলা হয় "আকাশের ত্বওই হয়া আর কাগজের ত্বওই হয়ার মাঝে যদি সাদৃশ্যতা থাকে, তাহলেত অবশ্যই আকাশ ও কাগজের মাঝে সাদৃশ্যতা থাকতে হবে, যার অর্থ আকাশ কাগজেরই মতো"। তাহলের এর জবাবে বলব : ত্বওই হয়া হচ্ছে একটা ক্রিয়া। আকাশের ত্বওই হয়ার ও কাগজের ত্বওই হয়ার মাঝে সাদৃশ্যতা থাকার অর্থ হলো আকাশের সাথে সংঘটিত একটি ক্রিয়ার ধরন ও কাগজের সাথে সংঘটিত সেই একই ক্রিয়ার ধরনের মধ্যে সাদৃশ্যতা থাকা। দুটি ভিন্ন বিষয়ের সাথে কোনো একটা নির্দিষ্ট ক্রিয়া সংঘটিত হয়ার ধরনের মধ্যকার সাদৃশ্যতার সহিত সেই দুটি বিষয়ের ব্যাহ্যিক গঠন-প্রকৃতির সাদৃশ্যতার কোনো সম্পর্ক নেই, বরং যদি কোনো দুটি বিষয়ের দৈহ্যিক গঠন-প্রকৃতির মাঝে আকাশ পাতাল পার্থক্যও থেকে থাকে, তাহলেও তাদের সাথে একটা নির্দিষ্ট ক্রিয়া সংঘটিত হয়ার ধরনের মাঝে সাদৃশ্যতা থাকতে পারে। যেমন মানুষ খাদ্য গ্রহণ করে, আবার ইদুরও খাদ্য গ্রহণ করে, খাদ্য গ্রহণ করার ধরনের ক্ষেত্রে মানুষের খাদ্য গ্রহণ করার ধরন আর ইদুরের খাদ্য গ্রহণ করার ধরনের মধ্যে অনেক সাদৃশ্যতা আছে, অথচ মানুষ ও ইদুরের দৈহ্যিক আকার ও গঠন-প্রকৃতির মাঝে আকাশ পাতাল পার্থক্য রয়েছে।কাজেই আকাশের ত্বওই হয়া ও কাগজের ত্বওই হয়ার ধরনের মধ্যে সাদৃশ্যতা থাকার মানে এই না যে তাদের দৈহ্যিক গঠন প্রকৃতির মাঝে সাদৃশ্যতা থাকতে হবে কিংবা আকাশকে কাগজের মত হতে হবে।

সুরা 39 এর আয়াত 67 এ আল্লাহ বলেন ;

وَٱلْأَرْضُ جَمِيعًا قَبْضَتُهُۥ يَوْمَ ٱلْقِيَـٰمَةِ وَٱلسَّمَـٰوَٰتُ مَطْوِيَّـٰتٌۢ بِيَمِينِهِ

আবার এই আয়াতটির সমার্থক একটি হাদিসও রয়েছে, হাদিসটি নিম্নরুপ ;

عَنْ ‌أَبِي هُرَيْرَةَ، عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: «يَقْبِضُ اللهُ الْأَرْضَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ، وَيَطْوِي السَّمَاءَ بِيَمِينِهِ، ثُمَّ يَقُولُ: أَنَا الْمَلِكُ، أَيْنَ مُلُوكُ الْأَرْضِ…[60]

উল্লেখ্য, এই আয়াত ও হাদিসে বলা হয়েছে যে আকাশমন্ডলী আল্লাহর ডান হাতে থাকবে। কিন্ত পৃথিবী কোন হাতে থাকবে সেব্যাপারে কিছু বলা হয়নি। পৃথিবী কোন হাতে থাকবে সেব্যাপার নিয়ে সালাফ মুফাসসিরদের মাঝে মতভেদ হয়েছে, তাঁদের একাংশের মতে পৃথিবীও আকাশমন্ডলীর সহিত ডান হাতেই থাকবে, এবং আরেক অংশের মতে পৃথিবী বাম হাতে থাকবে [61]। যেহেতু এই আয়াতে ও হাদিসে পৃথিবী কোন হাতে থাকবে সেব্যাপারে কিছু বলাই হয়নি, এবং সালাফদের মাঝে পৃথিবী কোন হাতে থাকবে সেব্যাপারে মতভেদ আছে ; সেহেতু পৃথিবী কোন হাতে থাকবে সেব্যাপারে নিশ্চিতভাবে এমনটা বলার সুযোগ নেই যে আকাশমন্ডলী ডান হাতে থাকলে পৃথিবী অপর হাতে তথা বাম হাতে থাকবে, কেননা এমনটাও হতে পারে যে পৃথিবী ও আকাশমন্ডলী উভয়েই একত্রে সম্মিলিতভাবে একইসাথে ডান হাতেই থাকবে।

এবার আসা যাক 'আকাশমন্ডলীকে গুটিয়ে নেয়' প্রসঙ্গে। পুর্বে উল্লেখিত আয়াতটির মত এই আয়াত ও হাদিসেও 'ত্বওই' ধাতু হতে আগত শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে, অর্থাৎ এখানে বোঝনো হয়েছে যে আল্লাহ আকাশকে ত্বওই করে অর্থাৎ অপ্রসারিত অবিস্তৃত করে আয়তন কমিয়ে তাঁর ডান হাতে নিবেন। আর এক্ষেত্রে যেই 'গুটিয়ে নেয়া' অনুবাদটি করা হয়, সেটি ভুল না হলেও সেটার সীমাবদ্ধতা বা দুর্বলতা রয়েছে। প্রসারণের বিপরীত ক্রিয়া বোঝানোর জন্য ভাজ করা বা গোটানো কথাগুলো ব্যবহৃত হয়ার দরুন ত্বওই এর বাংলা অনুবাদে এধরনের কথা অর্থ হিসেবে উল্লেখ্য করা হয়। তবে প্রকৃতপক্ষে ত্বওই এর অর্থ ভাজ করা ও গুটিয়ে নেয়ার চেয়ে আরো অনেক বেশি বিস্তৃত, যেকোনোভাবে প্রসারণের বিপরীত ক্রিয়া সংঘটিত হলেই ত্বওই হয়, এরজন্য ভাজকৃত হয়া বা গুটানো হয়া কোনো শর্ত নয়। ভাজ হয়া বা গুটানো হয়া ব্যাতিতও ত্বওই হতে পারে।

(2.13)
ত্রয়োদশ অভিযোগ :-  কেয়ামতের সময় আকাশ লাল গোলাপের মত হয়ে যাবে। এটা বৈজ্ঞানিক ভুল।

জবাব :-

সুরা 55 এর আয়াত 37 এ বলা হয়েছে যে ;

فَإِذَا ٱنشَقَّتِ ٱلسَّمَآءُ فَكَانَتْ وَرْدَةً كَٱلدِّهَانِ
"যখন আকাশ দীর্ণ বিদীর্ণ হবে ফলে লাল চামড়ার মত লালবর্ণ ধারণ করবে"

আকাশের লাল-গোলাপের মত হয়ে যাওয়ার মানে মোটেও এইনা যে আকাশের গঠন-প্রকৃতি লাল গোলাপের মতো হয়ে যাবে, বরং এই আয়াতে বোঝানো হয়েছে যে কেয়ামতের সময় আকাশে 'রঙ' লাল গোলাপের মতো 'রং' এর মতো হয়ে যাবে, অর্থাৎ এখানে সেসময়ের আকাশের রং এর সাথে লাল গোলাপের রংকে তুলনা করা হয়েছে [62]। দুটি ভিন্ন জিনিসের রঙ একইরকম হয়ার মানে সেই দুটি জিনিসের গঠন-প্রকৃতির মাঝে সাদৃশ্যতা থাকবে, এমন চিন্তাভাবনা শুধুমাত্র মানসিকভাবে অসুস্থ লোকজনই নিজেদের মাথায় রাখতে পারে। আর এখানে বলা হচ্ছে কেয়ামতের সময়ের কথা, এমনেতেই বিজ্ঞান মহাবিশ্বের অনেক কিছু সম্পর্কে এখনো জানেনা, তার উপর আবার কেয়ামতের সময় এমন এমন সব ঘটনা ঘটবে যেগুলোর কোনো কৈফিয়ত ও কারণ মানুষের বুঝে আসবেনা। কাজেই ভবিৎষতে ঘটবে এমন  একটা কেয়ামত সক্রান্ত অলৌকিকজাতীয় ঘটনার পিছনে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা খোজা অর্থহীন ও অবান্তর।

(2.14)
চতুর্দশ অভিযোগ :- কেয়ামতের সময় আকাশ গলিত ধাতু /তেলের তলানীর মত হয়ে যাবে। অর্থাৎ আকাশ হচ্ছে এমন কঠিন পদার্থ দ্বারা তৈরি বস্তু যা গলিত ধাতু/তেলের তলানীর মত হয়ে যেতে পারে।

জবাব : এই দাবিটির ভিত্তি হচ্ছে সুরা আল-মায়ারিজের আট নং আয়াত, যেখানে আল্লাহ বলেছেন ;

يوم تكون السماء كالمهل
'যেদিন আকাশ গলিত ধাতু/তেলের তলানীর মতো হয়ে যাবে '

উল্লেখ্য যে, এখানে ব্যবহৃত مهل শব্দটির অর্থ নিয়ে মুফাসসিরদের মাঝে বিপুল সংখ্যাক ভিন্ন ভিন্ন মতামত আছে, সেসব মতামতের মধ্যে 'গলিত ধাতু ' ও 'তেলের তলানী' এদুটি মত অধিক প্রসিদ্ধি লাভ করেছে।

এবার মুল আলোচনায় এগোনো যাক।

এই আয়াতটিতে বলা হয়েছে যে কেয়ামতের সময় আকাশ গলিত ধাতু কিংবা তেলেনের তলানীর মত হয়ে যাবে। এখন এরমানে এইনা যে আকাশের দৈহ্যিক গঠন-প্রকৃতি مهل এর মতো হয়ে যাবে, এই আয়াতে আকাশের مهل এর মত হয়ে যাওয়ার কথা উল্লেখ্য করার ক্ষেত্রে  مهل ও আকাশের দৈহ্যিক গঠন-প্রকৃতির সাদৃশ্যতা তৈরি হয়া বোঝানো হয়নি।

বরং এই আয়াতে আকাশের مهل এর মত হয়ে যাওয়া বলতে যা বোঝানো হয়েছে তা হলো এই যে আকাশের 'রং' কেয়ামতের সময় مهل এর রঙ এর মত হয়ে যাবে। অর্থাৎ আলোচ্য আয়াতটিতে কেয়ামতের সময় আকাশের রঙ ও مهل এর রঙ এর মধ্যকার সাদৃশ্যতা বোঝানো হয়েছে। আয়াতটিতে নিছক 'রং' এর দিক দিয়ে সাদৃশ্যতা উদ্দেশ্য [63]। আর এই আয়াতের ব্যাপারে কাতাদাহ বিন দায়ামাহ ও এরুপ ব্যাখ্যাই দিয়েছেন।[64]

ত্রয়োদশ অভিযোগের জবাব হতে পুনরাবৃত্তিস্বরুপ আবারো বলছি, যে "দুটি ভিন্ন জিনিসের রঙ একই হয়ার মানে সেই দুটি জিনিসের গঠন-প্রকৃতির মাঝে সাদৃশ্যতা থাকবে, এমন চিন্তাভাবনা শুধুমাত্র মানসিকভাবে অসুস্থ লোকজনই নিজেদের মাথায় রাখতে পারে।"

(2.15)
পঞ্চদশ অভিযোগ :- সুরা 25 এর আয়াত 25 এ বলা হয়েছে যে আকাশ মেঘমালার সহিত /মেঘমালার দ্বারা বিদীর্ণ হবে ও ফেরেশতাদের নামিয়ে দেয়া হবে, এটা খুবই বড় ধরনের বৈজ্ঞানিক ভুল।

জবাব :- সুরা 25 এর আয়াত 25 নিম্নরুপ,

ويوم تشقق السماء بالغمام و نزّل الملائكة تنزيلا

"সেদিন আকাশ গামামের দ্বারা বিদীর্ণ হবে ও ফেরেশতাদের নামিয়ে দেয়া হবে "

এখানে কিছু বিষয় উল্লেখ্য, "গামাম" শব্দটির অর্থ হলো 'মেঘ' বা 'ধোয়া '। অপরদিকে এই আয়াতের কিছু কিছু অনুবাদে বলা হয়েছে 'গামামসহ' বা 'গামামের সহিত', তবে এখানে প্রকৃত শাব্দিক অর্থটা হবে 'গামামের দ্বারা'।

এবার মুল আলোচনায় আসা যাক।

কেয়ামতের দুটি পর্ব রয়েছে, প্রথম পর্বে মহাবিশ্বের সকলকিছু ধ্বংস হবে, এবং দ্বিতীয় পর্বে নতুন করে হাশরের ময়দান সৃষ্টিপুর্বক সকলকে বিচারের জন্য হাশরের ময়দানে জিবীত করে আনা হবে। এই আয়াতটিতে কেয়ামতের দ্বিতীয় পর্বের একটি ঘটনা উল্লেখ্য করা হয়েছে, কেয়ামতের প্রথম পর্বের ঘটনাসমুহের অন্তর্ভুক্ত কোনোকিছু এখানে উল্লেখ্য করা হয়নি। [65]আর হাশরের ময়দানের পরিবেশ বর্তমানের কেয়ামতের পুর্বের সাধারন পরিবেশের চেয়ে অনেক বেশি পার্থক্যবিশিষ্ট ও সম্পুর্ণ ভিন্ন ধরনের হবে। বর্তমানের আকাশ আর হাশরের ময়দানের আকাশ একইরকম হবেনা, বরং সম্পুর্ণ ভিন্ন রকমের হবে, কাজেই বর্তমানের আকাশ সক্রান্ত কোনো বৈজ্ঞানিক তথ্য হাশরের ময়দানের আকাশের জন্য প্রযোজ্য হবেনা। প্রকৃতপক্ষে হাশরের ময়দানের সাথে সম্পর্কিত বিষয়গুলো বিজ্ঞানের জানার ক্ষমতার সীমানার বাহিরের বিষয়।

(2.16)
ষোড়শ অভিযোগ :- "কোরানের অনেকগুলো আয়াতে বলা হয়েছে যে কেয়ামতের সময় আকাশ বিদীর্ণ হবে। অর্থাৎ বায়ুমন্ডল/মহাশুন্য হচ্ছে শক্ত কোনোকিছু যা ভেঙ্গে যেতে পারে "

জবাব :

আকাশ বিদীর্ন হয়া বুঝানোর ক্ষেত্রে কোরানে প্রধানত ২ টি শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। একটি হলো الفطر, ও আরেকটি হলো الشق, এদুইটি শব্দ একে অন্যের পরিপুরক [66] এই الشق শব্দটি দ্বারা "বিস্ফোরিত হয়ে চুর্ন-বিচুর্ন লন্ডভন্ড হয়া " বুঝানো হয়, এবং কোর'আনে আকাশ বিদীর্ন হয়া বুঝানোর জন্য الشق শব্দটি এই অর্থেই ব্যবহৃত হয়েছে।[67]

মহাকাশের সাত আসমানের সাতটি কঠিন পদার্থের শক্ত স্তর, কঠিন পদার্থের বিভিন্ন শক্ত মহাকাশীয় বস্তু, বিভিন্ন গ্যাসীয় মহাকাশীয় বস্তু ইত্যাদি এমন জিনিসগুলো সবই একত্রে 'আকাশ' হিসেবে গণ্য হতে পারে। কিংবা শুধুমাত্র সাত আসমানের সাতটি শক্ত স্তরও নির্দিষ্টভাবে এককভাবে একাই 'আকাশ' হিসেবে গন্য হতে পারে (প্রায়সময়ই কোরানে সাত আসমানের সাতটি শক্ত স্তরকে আকাশ বা আকাশমন্ডলী হিসেবে উল্লেখ্য করা হয়েছে)। আর এসব জিনিসগুলোর জন্য (তথা এককভাবে সাত আসমানের সাতটি শক্ত স্তরের জন্য কিংবা সাত আসমানের পাশাপাশি বিভিন্ন বায়বীয় ও কঠিন মহাকাশীয় বস্তুর জন্য) বিস্ফোরিত হয়ে চুর্ন-বিচুর্ন লন্ডভন্ড হয়ার ব্যাপারটা সম্ভব ও প্রযোজ্য হয়ার যোগ্য। কাজেই আকাশ বিদীর্ণ হয়ার কিংবা বিস্ফোরিত হয়ে চুর্ন-বিচুর্ন লন্ডভন্ড হয়ার জন্য বায়ুমন্ডলের কিংবা মহাশুন্যের কোনো কঠিন পদার্থ হয়া জরুরি নয়। অতএব আকাশকে বিদীর্ণ করা সক্রান্ত আয়াতগুলোকে কেন্দ্র করে এমন দাবি করা যৌক্তিক হবেনা যে সেসব আয়াত অনুযায়ী বায়ুমন্ডল বা মহাশুন্য শক্ত কোনো বস্তু হিসেবে সাব্যস্ত হয় ।উক্ত অভিযোগের মুল জবাব হিসেবে এতটুকু বলাই যথেষ্ট। তবে আরো কিছু বিষয় সুস্পষ্ট করার স্বার্থে আকাশ বিদীর্ণ হয়া সক্রান্ত আয়াতগুলোকে একত্রে উল্লেখ্য করে আয়াতগুলোর ব্যাপারে কিছু সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হলো।

সুরা 84/ আয়াত 1 :
(إذا السماء انشقت)
অর্থ : যখন আকাশ বিদীর্ন হবে

সুরা 55/আয়াত 37 :
(فإذا انشقت السماء فكانت وردة كالدهان)
অর্থ : যখন আকাশ বিদীর্ন হবে তখন তা গোলাপের ন্যায় লালবর্ন ধারন করবে

সুরা 69 /আয়াত 16 :
(وانشقت السماء فهي يومئذ واهية)
অর্থ : যেদিন আকাশ বিদীর্ন হবে সেদিন তা হবে বিক্ষিপ্ত বিশৃঙ্খল, তুচ্ছ।

সুরা 78/আয়াত 19 :
(فتحت السماء فكانت أبوابا)
অর্থ : আকাশ বিদীর্ন হবে ও তাতে বহু দরজা খুলে যাবে

সুরা 77/আয়াত 9 :
(إذا السماء فرجت)
অর্থ : যেদিন আকাশ বিদীর্ন হবে

সুরা 82/আয়াত 1 :
(إذا السماء انفطرت)
অর্থ : যখন আকাশ বিদীর্ন হবে

এই ছয়টি আয়াতে যা বুঝানো হয়েছে তা হলো : "আকাশ বিস্ফোরিত হবে, চুর্ন-বিচুর্ন হবে বিক্ষিপ্ত হবে লন্ডভন্ড হবে।তাতে বহু দরজা তথা রাস্তা বা প্রবেশপথ প্রকাশিত হবে " [68]

লক্ষ্য করুন (এক) - সুরা 78 এর আয়াত 19 এ فتحت শব্দটি তার প্রধান শাব্দিক অর্থে ব্যবহার না হয়ে "বিস্ফোরিত হয়ে চুর্ন-বিচুর্ন লন্ডভন্ড হয়া" অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। আর এই আয়াতে বর্ণিত 'আকাশের দরজা' বলতে বোঝানো হয়েছে 'পথ' বা 'রাস্তা', সাধারণ অর্থের দরজা বোঝানো হয়নি …[69]। আকাশের দরজা সম্পর্কে বিস্তারিত জবাব দেখতে চাইলে দশম অভিযোগের জবাবটি দেখে আসুন।

লক্ষ্য করুন (দুই) - সুরা 77 এর আয়াত 9 এ فرجت শব্দটি তার প্রধান শাব্দিক অর্থে ব্যবহার না হয়ে "বিস্ফোরিত হয়ে চুর্ন-বিচুর্ন লন্ডভন্ড হয়া" অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে [70]

সুরা 19/আয়াত 90 :
تكاد السماوات يتفطرن منه
অর্থ : এতে আকাশমন্ডলী বিদীর্ন হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়
                                             
পুর্বে উল্লেখিত আয়াতগুলোর মত এই আয়াতটিতেও বিস্ফোরিত হয়ে বিক্ষিপ্ত চুর্ণ-বিচুর্ণ হয়া বুঝানো হয়েছে। কাফেররা যখন বলে "আল্লাহ সন্তান নেন " তখন আল্লাহর রাগ ও মহত্বের দরুন আকাশের এরুপ হয়ার উপক্রম দেখা দেয়। …[71]

সুরা 42/আয়াত 5 :

تكاد السماوات يتفطرن من فوقهن و الملائكة يسبحون بحمد ربهم ويستغفرون لمن في الأرض
আকাশমন্ডলী উর্ধ্বদেশ হতে বিদীর্ন হয়ার উপক্রম হয় এবং ফেরেশতারা তাদের রবের সপ্রশংস পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে এবং পৃথিবীতে যে আছে তার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে।

এই আয়াতটিতে বলা হয়েছে যে আল্লাহর মহত্বের কারনে আকাশমন্ডলী বিস্ফোরিত, চুর্ন বিচুর্ন ও বিক্ষিপ্ত হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। [72]

লক্ষ্য করুন (তিন) - সুরা 42 এর আয়াত 5 সম্পর্কে অনেকে দাবি করে এই আয়াতে নাকি বলা হয়েছে আকাশ বিদীর্ন হয়ে পৃথিবীর উপর "পতিত " হয়ার উপক্রম হয়। এটা ভুল ও ভিত্তিহীন দাবি। আকাশ বিদীর্ন হয়ে পৃথিবীর মানুষদের উপর "পতিত " হয়ার কথা এখানে বলা হয়নি। যদিও কিছু বাংলা অনুবাদ পড়লে এমন মনে হতে পারে তবে বাস্তবে আয়াতটিতে এইধরনের কিছু বলা হয়নি।

লক্ষ্য করুন (চার)- অনেকে দাবি করে যে সুরা 42 এর আয়াত 5 হতে বুঝা যায় যে ফেরেশতাদের দোয়ার কারনে আকাশমন্ডলী পৃথিবীর উপর বিদীর্ন হয়ে পতিত হয়না। এটাও ভুল দাবি। কেননা আয়াতের ফেরেশতাদের দোয়া করা বিষয়ক অংশটি নাজিল হয়েছে একেবারেই ভিন্ন প্রেক্ষাপটে, ভিন্ন উদ্দেশ্যে ; এ অংশটির প্রসঙ্গ, মর্ম, উদ্দেশ্য, ব্যাখ্যা, তাৎপর্য সবই ভিন্ন [73]

সুরা 73/আয়াত 18 :
(والسماء منفطر به)
অর্থ : যখন আসমান তার দ্বারা বিদীর্ন হবে

এখানেও বিদীর্ন হয়ার বিষয়টা পুর্বে উল্লেখিত আয়াতেরই মত। অর্থাৎ আকাশ বিস্ফোরিত, বিক্ষিপ্ত, চুর্নবিচুর্ন হবে [74] এক্ষেত্রে অনেক উলামাগন বলেছেন যে এখানে আকাশ ভেদ করে আল্লাহর আগমনের বিষয়টা বলা হয়েছে [75] যদি এখানে আল্লাহর আগমনেরর বিষয়টা উদ্দেশ্য হয় তাহলে এই আয়াতটিতে হাশরের ময়দানের ঘটনা বর্নিত হয়েছে।কেননা হাশরের ময়দানেই আল্লাহ নিজে আসবেন।

সুরা 25/ আয়াত 25 :

(পঞ্চদশ অভিযোগের জবাবটি আবার দেখে আসুন)।

3.উপসংহার : এপর্যন্ত এসে লেখাটির সমাপ্তি ঘটলো, এই লেখাটিতে আকাশ সক্রান্ত প্রসিদ্ধ প্রচলিত ও বহুল আলোচিত কিছু অভিযোগের জবাব দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। আমা আশা করি যাদের মনে কোরানে বর্ণিত আকাশসক্রান্ত বিভিন্ন তথ্য নিয়ে সন্দেহ-সংশয় রয়েছে তারা এই লেখাটি দ্বারা উপকৃত হতে পারবেন।

4.টিকাসমুহ :

[1]http://bangladict.com/%E0%A6%86%E0%A6%95%E0%A6%BE%E0%A6%B6 অথবা bangladict.com/আকাশ

[2]আরবি ভাষাবিদ ও মুফাসসির আবু-জাফর মুহাম্মদ ইবনু জারির আত-তাবারী তাঁর তাফসিরগ্রন্থ 'জামিউল বায়ান'(1/388) এ 'সামা' শব্দটির উক্ত সংজ্ঞাটি উল্লেখ্য করেছেন

[3] আল-কিরাফী, নাফাইসুল উসুল (2/796)

[4]উল্লেখিত ৫০ জন আলেম যে আসলেই সামা শব্দটির উক্ত সংজ্ঞাটির প্রতি সমর্থন দিয়েছেন, সেটার প্রমাণ তাঁদের বিভিন্ন বই হতে নিম্নে উল্লেখ্য করা হলো :

\\মাকাইসুল লুগাহ (3/98),মুজমালুল লুগাহ (পৃ/472),ফাতহুল কারিবিল মুজিব (1/161)
আল-ই'লাম বিলফাওয়াইদ (1/95),মা'আনিয়ুল কোর'আন (1/75),দাকাইকুত তাফসির (2/258),মাজমুয়ুল ফাতাওয়া (12/248),দার'উত তা'আরুয (7/16),আল-কাওকাবুও ওয়াহহাজ (2/544),তাফসিরুস সাম'আনী (1/53),মাফাতিহুল গাইব (14/269)&(2/344),  তাফসির ইবন আতিয়াহ (1/105), মুহাসিনুত তা'ওইল (9/286), তাফসিরুল উসাইমিন জুযয়ে আম্ম (পৃ/147), লুকাউল বাবিল মাফতুহ (45/3),নাফাইসুল উসুল (2/796),ইকমালুল মু'লিম (1/330), আত-তামহীদ (5/15),তাফসিরুল বাইদ্বাওই (1/55),তাফসিরুল হাদ্দাদ (1/138), ইরাবু ছালাছিন সুরাহ (পৃ/37),উসুলুস সারখাসী (1/178),আল-আরবাওন (পৃ/53), আল-ইবানাহ লিআসসুহারী (2/48), আল-লুবাব ফিউলুমিল কিতাব (8/318) ,আল-হিদায়াহ লিমাক্কি (1/188),নাহযাতুল আ'ইয়ান (পৃ/358), আল-গারিবিন (3/936), আল-ইক্বতিযাব (3/119) , সুরুন নাফস (পৃ/197), নাছারুল আযহার (পৃ/172), তাহরিরুত তাহবির(পৃ/458), আল-ইবানাহ লিআল-আশয়ারী (পৃ/107), তারিখুত তাবারী (1/53),তাফসিরুত তাবারী (1/388),মানাকিবুশ শাফেঈ (1/397),আল-ই'তিকাদ (পৃ/ 113)তাহযিব সুনান আবি দাউদ (3/285),আদ্বওয়াউল বায়ান (7/488), তাফসিরুশ শাফেঈ (3/1063),আল-ক্বাইদ (পৃ/204), আস-সিরাজুল মুনির (2/630), তাফসিরুল কুরতুবী (1/126), তা'ওইলাতু আহলিস সুন্নাহ (1/399),তাফসিরুস সা'দী (পৃ/44), নিযমুদ্দ দূর (15/493),তুরাছুল মারাকাশী (পৃ/166),আত-তাহরির ওয়াত তানওইর (17/324),আয-যাওয়াজির (1/59),ফাতহুল বায়ান (6/249), লামসাত বায়ানিয়াহ (পৃ/273),আদ-দুররুল মাসুন (1/169), আল-আসালিব ওয়াল ইতলাকাত (পৃ/120-121),লাওয়ামিউল আনওয়ার (1/197),হুসুলুল মা'মুল (পৃ/67),নাতাইজুল ফিকর ফিন্নাহু (পৃ/124)\\

[5]আল-মাওরিদী, আন-নুকতু ওয়াল উয়ুন (3/92)

[6]অনেকে বলতে পারেন বা ভাবতে পারেন যে যেহেতু ইবনু আব্বাস (রা) অদৃশ্য স্তম্ভের মতটির পক্ষে, এরমানে অবশ্যই এমতটিই অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত অধিকসঠিক, ইবনু আব্বাসের (রা) চেয়ে বেশি তাফসির আর কারাই বা বোঝতে পারে? প্রাথমিকভাবে যদিও এই লজিকটা ঠিকই হয়ার কথা ছিলো, কিন্ত এক্ষেত্রে এই বক্তব্য বা ভাবনাটা সম্পুর্ণ ভুল ও সমস্যাজনক। কেননা এখানে একটি নির্দিষ্ট বিশেষ পরিস্থিতি আছে যা সাহাবি হিসেবে ইবনু আব্বাসের (রা) ব্যাখ্যার যেই বিশেষ মুল্য রয়েছে সেই বিশেষ মুল্যেকে বিলুপ্ত করে দেয়। পরিস্থিতিটা হচ্ছে এই যে : জৈনিক কোনো ব্যাক্তি বলছিলো যে আকাশের স্তম্ভ আছে, ইবনু আব্বাসের (রা) নিকট যখন বলা হয় যে একজন লোক এমনটা বলছে, তখন তিনি সেই লোকের সাথে একমত হোন, সেই লোকের দ্বারা প্রভাবিত হন, এবং কোরানের আয়াতকে সেই লোকের উক্ত মত অনুযায়ী ব্যাখ্যা করেন ও বলেন যে হ্যা, আকাশের স্তম্ভ আছে, আর কোরানের আয়াতগুলোতে বোঝানো হয়েছে যে আকাশের কোনো দৃশ্যমান স্তম্ভ নেই বরং অদৃশ্য স্তম্ভ রয়েছে।{১} এখন ইবনু আব্বাসের (রা) যুগে আকাশের দৃশ্যমান বা অদৃশ্য স্তম্ভ থাকার ধারনা প্রচার করতো আরবের আহলুল-কিতাবরা এবং ইসরাইলি জ্ঞানভান্ডার সম্পর্কে জ্ঞানী মুসলিমরা, {২}কাজেই অবশ্যই তিনি (রা) যেই লোকের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে এই মতটি দিয়েছেন সেই লোক ইসরাইলি তথ্যভান্ডার হতে প্রভাবিত হয়েই এমনটা বলছিলো যে আকাশের স্তম্ভ আছে, পক্ষান্তরে ইবনু আব্বাস (রা) ইসরাইলি তথ্য সমুহদ্বারা কোরানকে ব্যাখ্যার করার ক্ষেত্রে খাসভাবে মশহুর ছিলেন। কাজেই চুড়ান্ত ফলাফল দাড়ায় এই যে ইবনু আব্বাস (রা) আকাশের এই অদৃশ্য স্তম্ভ থাকার ধারনাটি ব্যাক্ত করেছেন ইসরাইলি তথ্যভান্ডার হতে গৃহীত তথ্যের অনুকূলে বা আলোকে কোরানকে ব্যাখ্যা করার মাধ্যমে, আর এই ধরনের ইসরাইলি তথ্যদ্বারা প্রভাবিত ব্যাখ্যা অকাট্য কোনোকিছুনা বরং ভুলও হতে পারে, কেননা গৃহীত ইসরাইলি তথ্যটারই ভুল হয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা থাকে, ব্যাখ্যাকারী সাহাবী হোক, তাবেঈ হোক, তাবে তাবেঈ হোক, যেই হোক, ইসরাইলি তথ্যের ক্ষেত্রে এই নিতী সবার জন্যই প্রযোজ্য। →উপটিকাসমুহ :{১} আত-তাবারী, জামিউল বায়ান (13/409) {২} সুনান সাইদ বিন মানছুর - তাকমিলাতুত তাফসির (7/219)

[7]https://binbaz.org.sa/audios/1323/%D8%AD%D9%83%D9%85-%D8%A7%D9%84%D8%A7%D8%B3%D8%B1%D8%A7%D9%89%D9%8A%D9%84%D9%8A%D8%A7%D8%AA

[8]আল-জাযযায, মায়ানিয়ুল কোরান ওয়া ইরাবুহু (4/195) ; আল-কুরতুবী, আল-জামি লিয়াহকামিল কোরান (9/279)

[9] হাদিসটি বর্ননা করেছেন : আল-বুখারী 'সহিহ' (হা/4537) এ, আত-তাবারানী 'আল-কাবির '(হা/10594) এ, ইবন মানদাহ 'আত-তাওহিদ'(1/105) এ, আল-বায়হাকী 'আল-আসমা ওয়াস সিফাত' (2/245) এ, আয-যাহাবী 'আল-উলুউ'(87) এ, এবং আবুশ-শায়খ 'আল-আযমাহ' (3/1039) এ।

[10]আত-তাবারী তাঁর 'জামিউল বায়ান'(2/208) এ উক্ত বর্ননাটি বর্ননা করেছেন।

[11]তাফসিরুল উসাইমিন : আর-রোম (পৃ/41)

[12]দেখুন : আল-বায়হাকীর "আল-আসমা ওয়াস সিফাত"(2/245)। ইবন তাইমিয়াহর "আল-ফাতাওয়াল কুবরা"(6/390) ও "আত-তাস'ইনিয়াহ "(1/327)। এবং ইবনু আবি-নাসরের "আল-জাময়ু বাইনাস সাহিহাইন"(2/99)। …(ইত্যাদি)

[13]আত-তাবারী, জামিউল বায়ান (24/94)

[14]সাওয়ালাতুল মাইমুনী (374),আদ্ব-দুয়াফাউল কাবির লিলউকাইলী (3/234),
দ্বিওয়ানুয যুয়াফা লিযযাহাবী (রাবি/2938),তাহযিবুল কামাল লিলমিযযী (20/491)

[15]ইবনু হিব্বান, কিতাবুল মাজরুহিন (2/40)

[16]আয-যারকাশী, আল-ইতকান ফি উলুমিল কোর'আন (পৃ/1087)

[17]আবু-হাইয়ান, আল-বাহরুল মুহিত (7/488)

[18]আল-মাওরিদী, আন-নুকত ওয়াল উয়ুন (3/444)

[19]https://islamqa.info/ar/225192

[20]মুহাম্মদ আল-হাওওত, আসনাল মাতালিব (পৃ/164)

[21]আদ-দারিমী, আর-রদ্দু আলাজ জাহমিয়াহ (ক্রম/81) & আর-রদ্দু আলাল মারিসী (1/471,519) ; ইবনু খুযাইমাহ, আত-তাওহিদ (1/242,244) ; আত-তাবারী, জামিউল বায়ান (23/78); আবুশ-শাইখ, আল-আযমাহ (2/688,3/1047) ; আবুল-লাইস, বাহরুল উলুম (1/169) ; আত-তাবারানী, আল-কাবীর (হা/8987) ; ইবনু আব্দিল-বার, আত-তামহিদ (7/139)।

[22]আল-খাদ্বির, শারহুল ইখতিসার (4/12) ; ইবনু হাজার, আন-নুকতু আলা ইবনিস সালাহ (2/532-533) & শারহুন নুখবাহ (পৃ/53) ; আল-হারবী, কাওয়াইদুত তারজিহ ইনদাল মুফাসসিরিন (1/201-203) ; আস-সুয়ুতী, তাদরিবুর রাওই (1/155) & আল-ইতকান (4/181) ; আল-মিনাওই, আল-ইয়ওয়াকিত ওয়াদ দুরার (2/486) ; দুরুসুল আলবানী (15/19) ; আবু-শুহবাহ, আল-ইসরাঈলিয়িয়াত (পৃ/303) … ইত্যাদি

[23]দেখুন:'আবুল-মুনযির মাহমুদ আল-মিনইয়াওই' এর "আশ-শারহুল কাবির লিমুখতাসারিল উসুল"(পৃ/408,টিকা-1)

[24]দেখুন : হাসান আল-হারবী, কাওয়াইদুত তারজিহ ইনদাল মুফাসসিরিন (1/202) & (1/201-202 তে বিস্তৃত 3 নং টিকা)

[25]দেখুন :'আহমদ ফাওযি ওয়াজিহ' কর্তৃক সংকলিত একটি ক্ষুদ্র বই 'আস-সাহাবাহ আল-ল্লাযিনা রাওয়াওও আন আহলিল কিতাব আও ইস্তামাউও লাহুম' এর সাহাবি নং 9।

[26]যেমন : সুরা আল-বাকারাহ, আয়াত 22 ; সুরা গাফির, আয়াত 64

[27]আল-কুরতুবী, আল-জামি লি'আহকামিল কোরান (1/229) ; ইবনুল ফারাস, আহকামুল কোরান (1/40)

[28] সুরা ক্বফ, আয়াত 6 ; সুরা আয-যারিয়াত, আয়াত 47 ; সুরা আশ-শামস, আয়াত 5, ইত্যাদি।

[29]ইবনু মানযুর, লিসানুল আরব (14/93)

[30]সুরা আত-তুর, আয়াত 5 ; সুরা আল-আম্বিয়া, আয়াত 32

[31]ইবনু ফারিস, মাকাইসুল লুগাহ (3/87)

[32] যেমন :- সুরা আস-সাফফাত, আয়াত 6 ; সুরা ফুসসিলাত, আয়াত 12 ; সুরা মুলক, আয়াত 5 ইত্যাদি ইত্যাদি।

[33]আল-মাতুরিদী, তা'ওইলাতু আহলিস-সুন্নাহ (8/546)

[34]আবুল-মুযাফফর, তাফসিরুস সাম'আনী (4/392)

[35]ইবনুল যাওযি, যাদুল মাসির(পৃ/1182)

[36]উল্লেখিত এই আলেমদের যেই বক্তব্যগুলো আমার এসব কথাকে সমর্থন করে, সেই বক্তব্যগুলোর উৎস উল্লেখ্য করা হলো। দেখুন : ইবনু আদিল, আল-লুবাব (16/277) ; আল-খাতিবুশ শিরবিনী, আস-সিরাজুল মুনির (3/370); আছ-ছায়ালবী, আজ-জাওয়াহিরুল হিসান (5/458) ; আর-রাযী, মাফাতিহুল গাইব (26/317) ; আল-বাকাঈ, নিযমুদ্দ-দুরার (20/230) ; আশ-শাওকানী, ফাতহুল ক্বাদির (পৃ/1511) ; তাফসিরুস-সা'দী (পৃ/876) ; ইবনু জুয্যাই, আত-তাসহিল (4/1568-1569) ; তাফসিরু ইবনে আশুর (23/47)

[37]সুরা ফাতির, আয়াত 41

[38]তাফসিরুত তাবারী (19/391-392) ; আছ-ছা'লাবী, আল-কাশফু ওয়াল বায়ান (8/115);ইবনু মানদাহ, আত-তাওহিদ (64) ; সুনানু সাঈদ বিন মানসুর তাকমিলাতুত তাফসির (7/124) ; তাফসিরু ইবনু আতিয়াহ (7/227)।

[39]তাফসিরু ইবনে আশুর (17/322) ; তাফসিরুল মারাগ্বী (17/137) ; তাফসিরু আহমদ হাতিবাহ {আশ-শামেলাহ} -( 36/7) ; মাজমায়ুল বুহুস, আত-তাফসিরুও ওয়াসিত (6/1252) ; ওহবাহ, আত-তাফসিরুল মুনির (17/264) & আত-তাফসিরুও ওয়াদ্বিহ (2/603)।

[40]সুরা 17, আয়াত 92 ; সুরা 52, আয়াত 44 ; সুরা 26, আয়াত 187 ; সুরা 34,আয়াত 9

[41]আবু-হাফস, আত-তাইসির (9/478); তাফসিরু মুকাতিল (2/550) ; তাফসিরু আবিস-সউদ (5/195) ; তাফসিরুন নিসফী (2/77) ; তাফসিরু ইবনে আশুর (15/209);তাফসিরু ইয়াহইয়া (1/162) ; ইবনু জুয্যাই, আত-তাসহিল (2/877) ; আশ-শাওকানী, ফাতহুল কাদির (পৃ/842) … ইত্যাদি

[42]আশ-শানকিতিঈ, আদ্বওয়াউল বায়ান (1/67)

[43] তাফসিরু ইবনে আশুর (27/79)

[44] ইবনু ফারিস, মাকাইসুল লুগাহ (4/510)

[45]তাফসিরুত তাবারী (23/119) ; ইবনুয-যুবাইর, আল-বোরহান (পৃ/343-344) ; আল-বাক্বাঈ, নিযমুদ দুরার (20/288) ; ইবনুল কাইইম, শিফাউল আলিল (1/219) ; তাফসিরু ইবনে আতিয়াহ (5/338)।

[46]আল-হারবী, কাওয়াইদুত তারজিহ ইনদাল মুফাসসিরিন (পৃ/527) 

[47]আল-মাওরিদী, আন-নুকতু ওয়াল উয়ুন (6/51)

[48] মুফাসসিরদের একটা বিরাট বড় অংশ এক্ষেত্রে উভয় মতকে একইসাথে গ্রহণ করেছেন। উদাহরণস্বরুপ : আত-তাবারী 'জামিউল বায়ান' (23/120) এ ও ইবনু কাসির তাঁর 'তাফসির'(8/197) এ।

[49] তাফসিরুত তাবারী (23/120)

[50] তাফসিরু ইবনে আতিয়াহ (5/338)

[51]আল-মাওরিদী,আন-নুকত ওয়াল উয়ুন 5/341

[52]ইবনু ফারিস, মাকাইসুল লুগাহ (4/498)

[53]আবু-হাইয়ান, আল-বাহরুল মুহিত (10/38); আছ-ছায়ালবী, আজ-জাওয়াহিরুল হিসান (5/338) ; তাফসিরু ইবনে আতিয়াহ (5/218) ; তাফসিরু ইবনে আশুর (27/182) ; তাফসিরু আবিস সউদ (8/169) ; মাজমায়ুল বুহুস, আত-তাফসিরুও ওয়াসিত  (9/1176) ; তাফসিরুল বাইদ্বাওই  (5/165) ; আয-যুহাইলী,আত-তাফসিরুল মুনির (27/156) ; … ইত্যাদি

[54]আল-আহাদিসুল মুখতারাহ (2/125)

[55]আল-আদাবুল মুফরাদ (হা/766) 

[56]ইবনু আব্বাস (রা) বলেছেন :  'মাজাররাহ ' মানে হলো আকাশের 'দরজা '। আলি  (রা) বলেছেন : 'মাজাররাহ' মানে হলো 'শারাজ' অর্থাৎ ( আকাশের এমন একটা পথ যা দুটি অঞ্চলকে যুক্ত করে) …(a)। ইবনু আব্বাস (রা) ও আলি (রা) এর এদুইটি  বক্তব্যের মাঝে সমন্বয় করলেই আকাশের দরজার এরুপ অর্থ পাওয়া যায়।একইভাবে আল-খালিল বলেছেন : 'মাজাররাহ ' মানে হলো আকাশের 'শারাজ' অর্থাৎ ( আকাশের এমন একটা পথ যা দুটি অঞ্চলকে যুক্ত করে)। আবু ইব্রাহিম আল-ফারাবি বলেছেন : 'মাজাররাহ ' মানে হলো আকাশের 'দরজা …(b)। আল-খালিল ও আবু-ইব্রাহিমের এদুইটি  বক্তব্যের মাঝে সমন্বয় করলেও আকাশের দরজার এরুপ অর্থ পাওয়া যায়।

উপটিকাসমুহ :

(a)আল-আদাবুল মুফরাদ (হা/767), আল-জামিউস সহিহ (1/170), আল-আদাবুল মুফরাদ (হা/766),আল-জামিউস সহিহ (1/169) 

(b)দিওয়ানুল আদাব (3/50) , আল-আইন (6/14)

[57]আল-মাওরিদী, আন-নুকতু ওয়াল উয়ুন (6/215)

[58] ইবনু সিদাহ, আল-মুহকাম (9/253) ; ইবনু মানযুর, লিসানুল আরব (15/18)

[59]মুহাম্মদ আলি আস-সাবুনী, সফওয়াতুত তাফাসির (2/254)

[60]সহিহুল বুখারী (হা/7382)

[61]তাফসিরুত তাবারী (20/246-251)

[62]তাফসিরুত তাবারী (22/226)

[63]হাসান ইযযুদ্দিন আল-জামাল, মুজামুন ওয়া তাফসিরুন লুগওইয়ুন লিকালিমাতিল কোরান (4/281)

[64]তাফসিরুত তাবারী (23/256)

[65]রাসুল (সা) হতে বর্ণিত একটি হাদিসে আছে যে তিনি (সা) আলোচ্য আয়াতে বর্ণিত "গামাম" সম্পর্কে বলেছেন যে তা হাশরের ময়দানে আর্বিভুত হবে।

হাদিসটি নিম্নরূপ :
عن النبي ﷺ قال يجمع الله الأولين والآخرين لميقات يوم معلوم قياماً أربعين سنة، شاخصة أبصارهم إلى السماء ينتظرون فصل القضاء، قال: وينزل الله -عز وجل- في ظلل من الغمام من العرش إلى الكرسي، ثم ينادي مناد: أيها الناس ألم ترضوا من ربكم… [a][b]
নবি (সা) বলেন : কেয়ামতের সময় আল্লাহ পুর্ববর্তি ও পরবর্তিদের একত্র করে ৪০ বছর দাড় করিয়ে রাখবেন। তাদের দৃষ্টি আকাশের দিকে থাকবে, আল্লাহ আরশ হতে কুরসি পর্যন্ত বিস্তৃত ধোয়ার (আয়াতে বর্নিত গামাম) সহিত আসবেন এবং ডেকে বলবেন : হে মানুষজন, তোমরাকি তোমাদের রবের প্রতি সন্তুষ্ট? 

উপটিকাসমুহ ;

[a]হাদিসটির উৎস : আত-তাব্রানী, আল-কাবির (9/416) ; আল-হাকিম, আল-মুস্তাদরাক (2/376-377) ; ইবনু মানদাহ, আত-তাওহিদ (2/583) ; ইবনু নাসর, আস-সালাহ (পৃ/278) ; ইবনু খুযাইমাহ, আত-তাওহিদ (2/584) ; আদ-দারাকুতনী, আর-রু'ইয়া (পৃ/162)

[a] হাদিসটির নির্ভরযোগ্যতা : এই হাদিসটি একটি সহিহ/হাসান হাদিস। বহু মুহাদ্দিস এই হাদিসটিকে সহিহ/হাসান বলেছেন। উদাহরণস্বরুপ ; আল-হাকেম, ইবনু মানদাহ, আল-মুনযারী, আল-হাইছামী, আল-আলবানী ও আদ-দারাকুতনী হাদিসটিকে 'সহিহ' বলেছেন, এবং আয-যাহাবী ও আল-আ'যামী হাদিসটিকে হাসান বলেছেন। দেখুন : আল-মুস্তাদরাক (2/376-377), হাশিয়াতু ইলালিদ-দারাকুতনী (5/244), আত-তারগিব (4/391), মাজমায়ুয যাওয়াইদ (10/343), সহিহুত তারগিব (3/418), আল-উলুউ (পৃ/200),ইলালুদ-দারাকুতনী (5/243-244), আল-জামিউল কামিল (12/456)

[66]ইবনু মানযুর, লিসানুল আরব (5/55) ; আয-যুবাইদী,তাজুল উরুস (13/325);
আর-রাযী,মুখতারুস সিহাহ (পৃ/241) ; ইবনুল যাওযি, গারিবুল হাদিস (2/200) ;আল-আযহারী,তাহযিবুল লুগাহ (13/222) ; আল-আসকারী,আল-ফুরুকুল লুগুইয়াহ (পৃ/407) ; নাশওয়ান,শামসুল উলুম (8/5215) ; আজ-জাওহারী, তাজুল লুগাহ (2/781)

[67]ইবনু ফারিস,মাকাইসুল লুগাহ (3/170) ; তাফসিরুত তাবারী (24/230)

[68]তাফসিরুত তাবারী (24/230) & (22/226) & (23/224) & (24/19) & (23/591) &  (24/174)

[69]তাফসিরুত তাবারী (24/19)

[70]তাফসিরুত তাবারী (23/591)

[71]তাফসিরুত তাবারী (15/637)

[72]তাফসিরুত তাবারী (20/466)

[73]তাফসিরুত তাবারী (20/468) ; মুস্তাদরাকুল হাকেম (2/480) 

[74]তাফসিরুত তাবারী (23/389)

[75]তাফসিরুস সাম'আনী (6/83) 

......