Are you sure?

ইতিহাস »  বিবিধ ইতিহাস

ফাতেমাহ (রা) ও আলি (রা) এর চাচাতো ভাইবোন হওয়া সম্পর্কিত বিভ্রান্তির জবাব

 

অভিযোগ :

আমরা সকলেই এটি জানি যে, হযরত আলী ছিলেন নবী মুহাম্মদের চাচাতো ভাই। নবী ছিলেন আবদুল্লাহর পুত্র, আর আলী ছিলেন তার ভাই আবু তালিবের পুত্র। কিন্তু সহিহ হাদিসে বর্ণিত আছে, নবী ফাতিমাকে জিজ্ঞেস করতেন, তোমার চাচাতো ভাই কোথায়? এর দ্বারা তিনি হযরত আলীকে নির্দেশ করতেন। কিন্তু আলী কীভাবে ফাতিমার চাচাতো ভাই হয়? আলী তো নবী মুহাম্মদের চাচাতো ভাই হওয়ার কথা। আসুন হাদিসগুলো পড়ি,

সহীহ বুখারী (ইসলামিক ফাউন্ডেশন)
৮/ সালাত
পরিচ্ছেদঃ ২৯৯। মসজিদে পুরুষের ঘুমানো।
ইসলামিক ফাউন্ডেশন নাম্বারঃ ৪২৮, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ৪৪১
৪২৮। কুতায়বা ইবনু সা’ঈদ (রহঃ) …. সাহল ইবনু সা’দ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফাতিমা (রাঃ) এর ঘরে এলেন, কিন্তু আলী (রাঃ)-কে ঘরে পেলেন না। তিনি ফাতিমা (রাঃ)-কে জিজ্ঞাসা করলেনঃ তোমার চাচাতো ভাই কোথায়? তিনি বললেনঃ আমার ও তাঁর মধ্যে কিছু ঘটেছে। তিনি আমার সাথে রাগ করে বাইরে চলে গেছেন। আমার কাছে দুপুরের বিশ্রামও করেন নি। তারপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক ব্যাক্তিকে বললেনঃ দেখ তো সে কোথায়? সে ব্যাক্তি খোঁজে এসে বললোঃ ইয়া রাসুলাল্লাহ! তিনি মসজিদে শুয়ে আছেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এলেন, তখন আলী (রাঃ) কাত হয়ে শুয়ে ছিলেন। তাঁর শরীরের এক পাশের চাঁদর পড়ে গিয়েছে এবং তাঁর শরীরে মাটি লেগেছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর শরীরের মাটি ঝেড়ে দিতে দিতে বললেনঃ উঠ, হে আবূ তুরাব! উঠ, হে আবূ তুরাব!
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
বর্ণনাকারীঃ সাহল বিন সা’দ (রাঃ)

সহীহ বুখারী (ইসলামিক ফাউন্ডেশন)
৬৬/ অনুমতি চাওয়া
পরিচ্ছেদঃ ২৬০০. মসজিদে কাইলুলা করা
৫৮৪৫। কুতায়বা ইবনু সাঈদ (রহঃ) … সাহল ইবনু সা’দ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। আলী (রাঃ) এর কাছে আবূ তুরাব এর চাইতে প্রিয়তর কোন নাম ছিল না। এ নামে ডাকা হলে তিনি অতান্ত খুশী হতেন। কারণ একবার রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফাতিমা (রাঃ) এর ঘরে আসলেন। তখন আলী (রাঃ) কে ঘরে পেলেন না। তিনি জিজ্ঞাসা করলেনঃ তোমার চাচাতো ভাই কোথায়? তিনি বললেনঃ আমার ও তার মধ্যে কিছু ঘটায় তিনি আমার সঙ্গে রাগারাগি করে বেরিয়ে গেছেন। আমার কাছে কায়লুলা করেননি। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক ব্যাক্তিকে বললেনঃ দেখতো সে কোথায়? সে লোকটি এসে বললঃ ইয়া রাসুলাল্লাহ! তিনি তো মসজিদে ঘুমিয়ে আছেন। তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এসে দেখতে পেলেন যে, তিনি কাত হয়ে শুয়ে আছেন, আর তার চাঁদরখানা পাশ থেকে পড়ে গেছে। ফলে তার সাথে মাটি লেগে গেছে। তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার গায়ের মাটি ঝাড়তে লাগলেন এবং বলতে লাগলেনঃ ওঠো, আবূ তুরাব (মাটির বাবা) ওঠো, আবূ তুরাব! একথাটা তিনি দু’বার বললেন।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
বর্ণনাকারীঃ সাহল বিন সা’দ (রাঃ)

জবাব :

হাদিসটিতে সরাসরি " চাচাতো ভাই" বলা হয়নি, বরং বলা হয়েছে "أين ابن عمك" (তোমার চাচার ছেলে কোথায়)?, "চাচার ছেলে " কে অনুবাদে "চাচাতো ভাই " লেখা হয়েছে, যা  হিসাব অনুযায়ি সঠিকই।

বাস্তবে আলি (রা) হলেন ফাতেমাহর (রা) পিতার (মুহাম্মাদের সা.) চাচাতো ভাই, আলি (রা) হলেন মুহাম্মাদ (সা) এর চাচা আবু-তালিবের ছেলে। উক্ত হাদিসটিতে "তোমার চাচার ছেলে কোথায়" দ্বারা একদম শাব্দিক অর্থ উদ্দেশ্য নয়। এখানে শাব্দিক অর্থে এটা বুঝানো হয়নি যে আলি (রা) ফাতেমাহর (রা) চাচার ছেলে বা চাচাতো ভাই। রাসুল (সা) "তোমার পিতার চাচার ছেলে কোথায়" বা "আলি কোথায় " বা "তোমার স্বামী কোথায় " না বলে বলেছেন "তোমার চাচার ছেলে কোথায়", এখানে "তোমার চাচার ছেলে কোথায় " দ্বারা উদ্দেশ্য হলো ফাতেমাহ (রা) কে এটা বুঝানো ও খেয়াল করানো যে তার (রা) ও তার স্বামী আলি (রা) এর মাঝে আত্নিয়তার সম্পর্ক রয়েছে,বংশগত নৈকট্য  রয়েছে। অর্থাৎ এরদ্বারা ফাতিমাহ (রা) ও আলির (রা) মধ্যকার বংশগত নৈক্যট্য ও আত্নিয়তার সম্পর্কটির দিকে জোর দেয়া হয়েছে, এবং এই বংশত নৈকট্য ও আত্নিয়তার সম্পর্ককে নির্দিষ্টভাবে, জোরালোভাবে ও বিশেষভাবে বুঝানোর  জন্যই রাসুল (সা) "তোমার পিতার চাচার ছেলে " না বলে "তোমার চাচার ছেলে " বলেছেন। এক্ষেত্রে "চাচার ছেলে" এর শাব্দিক অর্থটা উদ্দেশ্য নয়, যদিও ব্যাহ্যিকভাবে "চাচার ছেলে" বলা হয়েছে, কিন্ত এখানে এর প্রকৃত অর্থ ও উদ্দেশ্যটি ভিন্ন, এখানে "চাচার ছেলে" হচ্ছে "পিতার চাচার ছেলে" কথাটির একটি অতিরঞ্জিত রুপ, যাদ্বারা ইংগিত দেয়া হচ্ছে যে ফাতেমাহ (রা) ও আলি (রা) এর বংশত নৈকট্য সম্পর্ক রয়েছে। মুলত ব্যাপারটি আরবি ভাষার একটি বিশেষ সম্বোধন-রিতী। আরবরা মাঝে মাঝে এই ধরনের সম্বোধন রিতী ব্যবহার করে থাকে, যেখানে তারা সম্বোধনের বেলায় এমন একটা শব্দ বা বাক্য ব্যবহার করে যারদ্বারা তারা সেই শব্দ বা বাক্যের শাব্দিক অর্থটি  বুঝায়না।

বিষয়টিকে খুবই সহজ উদাহরনের সাহায্যে অনুধাবন করা সম্ভব। যেমন : পৃথিবীর কিছু কিছু স্থানে পিতা তার কন্যাকে আদর করে "মা" বলে সম্বোধন করে, আবার পৃথিবীর অন্য কিছু স্থানে সম্বোধনটি একেবারেই ব্যবহৃত হয়না, যেই স্থানে এই সম্বোধনটি ব্যবহৃত হয়না সেই স্থানের লোকজনদের নিকট পিতার কন্যাকে "মা" বলে সম্বোধন করাটা খুবই অদ্ভুত হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। পিতার নিজ কন্যাকে "মা" বলে সম্বোধন করার ক্ষেত্রে মোটেও শাব্দিকভাবে এটা উদ্দেশ্য হয়না যে সেই কন্যা উক্ত পিতার "বায়োলজিক্যাল মা"। বরং এই সম্বোধনটি হলো একটি উপমার ন্যায়, এরদ্বারা "আদর" উদ্দেশ্য। রাসুল (সা) এর সম্বোধনটিও ঠিক এই ক্যাটাগড়ির সম্বোধন, রাসুল (সা) এর সম্বোধনটি দ্বারা উদ্দেশ্য হলো "ফাতেমাহ ও আলি (রাদিয়াল্লাহু আনহুমা) এর মধ্যকার আত্নিয়তা ও বংশগত নৈকট্যের বিষয়টির উপর জোর দেয়া "।

রাসুল (সা) এর উক্ত সম্বোধনের যেই ব্যাখ্যা আমি উল্লেখ্য করেছি, সেটি আমার দেয়া কোনো ব্যাখ্যা নয়। বরং উক্ত ব্যাখ্যা আরবি ভাষা-সাহিত্যের উপর বিজ্ঞ মুহাদ্দিসদের ব্যাখ্যা। এই ব্যাখ্যাটির কিছু রেফারেন্স উল্লেখ্য করা হলো।

দেখুন :

(১) ইবন হাজার আল-আসকালানী রচিত "ফাতহুল বারী"(1/536)

(২) যাকারিয়া আল-আনসারী রচিত "তুহফাতুল বারী "(2/148)

(৩) আহমাদ আল-কাওরানী রচিত "আল-কাওছারুল জারি"(2/121)

(৪) শামসুদ্দিন আল-বিরমাওই রচিত "আল-লামিউস সাবিহ" (3/204)

(৫) আল-আমিন আল-হারারী রচিত "আল-কাওকাবুও ওয়াহহাজ" (23/461)

(৬) শিহাবুদ্দিন আল-কাস্তালানী রচিত "ইরশাদুস সারী"(1/437)

(৭) শামসুদ্দিন আল-কিরামানী রচিত "আল-কাওকাবুদ দারারী"(4/101)

(৮) বদরুদ্দিন আল-আইনী রচিত "উমতাদুল কারী"(4/199)

(৯) মুহাম্মাদ আল-ইথিয়িওবী রচিত "আল-বাহরুল মুহিতুস সাজ্জাজ" (38/598)

(১০)আব্দুল-কাদির আল-আস্তুওয়ানী রচিত "আসলুয যারারী"(পৃ/306)