Are you sure?

কুরআন »  বিবিধ

কুরআন সংকলনের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস।

॥ ১॥

আল কুরআন নাজীলের সূচনা ৬১০ খৃষ্টাব্দে । আল কুরআন রাসুলুল্লাহর  (ﷺ) জীবনঘনিষ্ঠ বিষয়বস্তু নিয়ে নাজীল হয়েছে খণ্ডে খণ্ডে, দীর্ঘ ২৩ বছরে। কুরআন পরিপূর্ণ রূপ পায় ৬৩২ ঈসায়ী সালে। কুরআনের প্রথম আয়াত সমুহ বদলে দেয় নবীজীর (ﷺ) জীবন। এরপর নবীজী (ﷺ) ও সাহাবীদের (رضي الله عنه) জীবন আবর্তিত হয় আল্লাহর কালাম তথা  কুরআনকে ঘিরেই । তাই সে সময় থেকেই কুরআনের প্রতিটি আয়াত বিশুদ্ধভাবে সংরক্ষণে প্রচেষ্টার কোনো কমতি ছিল না।  কুরআনের আয়াতাংশ, আয়াত, সূরা—যখনই যা নাজিল হতো, তখনই নবীজী (ﷺ) তা নিজে বার বার তেলাওয়াত করতেন এবং উপস্থিত সাথিদের শোনাতেন। সাহাবীরা ( رضي الله عنهمه) তা বার বার তেলাওয়াত করে মুখস্থ করে ফেলতেন। আর কাতীব অর্থাৎ লিপিকররা (رضي الله عنه) তা লিপিবদ্ধ করতেন। বিভিন্ন পর্যায়ে ৪০-এর অধিক সাহাবী (رضي الله عنه) কুরআন লিপিবদ্ধ করার দায়িত্ব পালন করেছেন।   নাজিলের সূচনা থেকেই মক্কায় নাবীজীর (ﷺ) সরাসরি তত্ত্বাবধানে সাহাবীরা(رضي الله عنه) মুখস্থ করা ও লেখার মাধ্যমে কুরআন সংকলন ও সংরক্ষণের কাজ শুরু করেন। কুরআন লিখে রাখার কাজে মোটা কাগজ, চামড়া, পাথরখণ্ড, জন্তুর হাড় ও খেজুর পাতা ব্যবহার করা হয়। আলী ঈবনে আবু তালিব, উবাই ঈবনে কাব, আবদুল্লাহ ঈবনে মাসাঊদ, যাঈদ বীন সাবীত (رضي الله عنهمه) কুরআন লিপিবদ্ধকারী হিসেবে বিশেষ খ্যাতিলাভ করেন। যাঈদ বীন সাবীতকে  (رضي الله عنهمه) নবীজী (ﷺ) তাঁর সামনে বসেই কুরআন লিপিবদ্ধ করার দায়িত্ব দিয়েছিলেন। কোনো আয়াত নাজিল হলেই তিনি তাকে ডেকে নিয়ে তিলওয়াত করে শোনাতেন। আয়াতটি কোন সূরার কোন আয়াতের আগে বা পরে কোথায় বসাতে হবে, সে-সম্পর্কে নির্দেশনা দিতেন। যাঈদ (رضي الله عنهمه) সেভাবে লিপিবদ্ধ করে শুদ্ধতা যাচাইয়ের জন্যে তা আবার নবীজীকে (ﷺ) পড়ে শোনাতেন। এভাবে পুরো কুরআন সূরা আকারে বিন্যাস্ত, লিপিবদ্ধ ও মুখস্থ করার নির্ভুল প্রক্রিয়া সুসম্পন্ন হয় নবীজীর (ﷺ) জীবদ্দশাতেই। [১]  নবীজী (ﷺ) মাদীনায় হীজরত করার পর কুরআন চর্চা নতুন গতি লাভ করে। মাসজীদে নববী সংলগ্ন চত্বরে নিবেদিতপ্রাণ সাহাবীদের এক বিশাল দল কুরআনের জ্ঞানে জ্ঞানী হওয়ার জন্যে নিজেদের উৎসর্গ করেন। নবীজীর (ﷺ) জীবদ্দশাতেই পুরো কুরআন মুখস্থ করেছেন এমন হাফীজের সংখ্যা ছিল কয়েক হাজার। আর যাঈদ বীন সাবীত, আলী ঈবনে আবু তালীব, উসমান ঈবনে আফফান, আবদুল্লাহ ঈবনে মাসাঊদ, উবাই ঈবনে কাব, সাঈদ ইবনুল আস, আবদুল্লাহ ঈবনে জুবাঈর, আনাস ঈবনে মালীক, আবদুর রহমান ঈবনে হারীস, মূয়াজ ঈবনে জাবল, খালীদ বীন ওয়ালীদ, আবদুর রহমান ইবনে শিহাব, আবু আইয়ুব আনসারী (رضي الله عنهمه) প্রমুখসহ ৬৫ জন সাহাবীর(رضي الله عنهمه) কাছে কুরআনের সব সূরা লিখিত আকারে ছিল। অর্থাৎ পুরো কুরআনই নাবীজীর (ﷺ) জীবদ্দশায় সূরা আকারে বিন্যস্ত ও লিপিবদ্ধ অবস্থায় ছিল; শুধু একত্রে ‘মূসহাফ’ আকারে গ্রন্থিত হয় নি। [১]

নাবীজীর (ﷺ) ওফাতের পরই আরবের বিভিন্ন এলাকায় ভণ্ড নবীর প্রাদুর্ভাব ঘটে। এদের বিদ্রোহ দমন করতে গিয়ে বহু হাফীজ শহিদ হন। তখন হযরত ওমরের (رضي الله عنه)  অনুরোধে প্রথম খালীফাহ হযরত আবু বকর (رضي الله عنه) পবিত্র কুরআনকে একত্রে গ্রন্থাকারে সংকলনের উদ্যোগ নেন। রসুলুল্লাহর (ﷺ) সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ কাতিব জাঈদ বীন সাবীতকে প্রধান করে হযরত আবু বকর (رضي الله عنه) একটি টিমকে এ-কাজের দায়িত্ব দেন।   খালীফাহ ফরমান জারি করেন যে, যার কাছে কুরআনের যে অংশ লিখিত আছে, তা যাঈদের কাছে হাজির করতে হবে। যাঈদ একইসাথে হাফীজ ও কাতীব ছিলেন। তিনি শুধু নিজের স্মৃতি ও লেখার ওপর নির্ভর করেন নি। তিনি তার কাছে লিখিত প্রতিটি আয়াতের সমর্থনে দুজন করে কাতীবের লেখার সাথে তা মিলিয়েছেন এবং সেই কাতীব যে রসুলুল্লাহর (ﷺ) সামনে এই আয়াত লিপিবদ্ধ করেছেন, তার সপক্ষে দুজন সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ করেছেন। একইসাথে সেই আয়াত দুজন হাফীজ একইভাবে মুখস্থ করেছেন কিনা এবং তিনি যে রসুলুল্লাহর (ﷺ) সামনে সেই আয়াত শুনে মুখস্থ করেছেন, তার সপক্ষে দুজন সাক্ষী তলব করেছেন। রসুলুল্লাহ (ﷺ) যে-রকম নির্ভুলভাবে আল্লাহর কালামকে পেশ করেছেন, সংকলনের ক্ষেত্রেও সাহাবীরা ছিলেন একইরকম আন্তরিক ও সত্যনিষ্ঠ। গ্রন্থাকারে সংকলন যাতে নির্ভুল হয়, সেজন্যে তারা সবরকম সতর্কতাই গ্রহণ করেছিলেন। [২]  রসুলুল্লাহর (ﷺ) জীবদ্দশায় লিপিবদ্ধ কুরআন আর যাঈদ বীন সাবীতের  (رضي الله عنه)  নেতৃত্বে সংকলিত এই মূসহাফের মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে যে, রসুলুল্লাহর (ﷺ) সময় কাগজ, চামড়া, পাথর, খেজুর পাতা—যা পাওয়া গেছে তাতেই লিপিবদ্ধ করা হয়েছে আর মূসহাফে একই সাইজের কাগজে লিপিবদ্ধ করে একটার পর একটা কাগজ সাজিয়ে ওপরে-নিচে শক্ত মলাট দিয়ে বাঁধাই করা হয়েছে। শক্ত মলাট দিয়ে বাঁধাই করার কারণেই এর নামকরণ হয়েছে ‘মূসহাফ’। মূসহাফ তৈরি হওয়ার পর সাহাবীরা ( رضي الله عنه ) সর্বসম্মতভাবে একে সঠিক বলে সত্যায়িত করেন এবং হযরত আবু বকরের (رضي الله عنه) কাছে সংরক্ষণের জন্যে পেশ করেন। তিনি রাষ্ট্রীয় মূহাফেজখানায় তা সংরক্ষণ করেন। 

রাসুলুল্লাহর (ﷺ) ওফাতের একবছরের মধ্যেই সম্পূর্ণ কুরআন একত্রে গ্রন্থাকারে সংকলনের এই কাজ সম্পন্ন হয়। এ সময়ে প্রত্যেকটি সূরা পৃথক পৃথক  গ্রন্থ বা সহিফা আকারে লিপিবদ্ধ করা হয় । এরপর এই সহীফাসমূহ একসাথে করে সম্পূর্ণ কুরআন সংকলন সুসম্পন্ন হয় । এটি কুরআন মাজীদের সর্বপ্রথম কিতাব আকারে প্রামাণ্য মূল কপির মর্যাদা লাভ করে যাকে ‘ঊম’ বলা হয়  [২] [৩]

হযরত আবু বকরের (رضي الله عنه) পর হযরত ওমর (رضي الله عنه) এই মূসহাফ সংরক্ষণ করেন ।  তাঁর সময় খেলাফতের সীমানা পারস্য থেকে লিবিয়া এবং আরব সাগর থেকে আজারবাইজান পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়। তিনি এই বিশাল অঞ্চলে অভিন্ন উচ্চারণ ও বাক্-রীতিতে পবিত্র কুরআন পঠনপাঠনের কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করেন।  পুরো কার্যক্রম তদারকির জন্যে তিনি আবদুল্লাহ ইবনে মাসাঊদ, আবু মুসা আশয়ারী, মূয়াজ ইবনে জাবলসহ ১০ জন বিশিষ্ট সাহাবীকে খেলাফতের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রেরণ করেন। হযরত ওমরের (رضي الله عنه) মৃত্যুর পর এই মূসহাফ তাঁর কন্যা ও উম্মুল মুমীনীন হযরত হাফসার (رضي الله عنه) হেফাজতে সংরক্ষিত হয়। [৩]

তৃতীয় খলিফা হযরত ঊসমানের (رضي الله عنه) সময় খেলাফতের আরো বিস্তৃতি ঘটে। তিনি সব অঞ্চলে অভিন্ন পঠনপাঠনরীতি অব্যাহত রাখার লক্ষ্যে কুরআনের কপি করার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি হযরত হাফসা-র (رضي الله عنه) কাছে সংরক্ষিত মসহাফ চেয়ে পাঠান। তিনি কুরাইশদের পঠন ও লিখনরীতি অনুসারে মূসহাফের কপি করার জন্যে প্রধান কাতিব জায়েদ বিন সাবিত, আবদুল্লাহ ইবনে জুবাইর, সাঈদ ইবনুল আস, আবদুর রহমান ইবনে হারিস, উবাই ইবনে কাব সহ ১২ জন সাহাবীর  (رضي الله عنهمه)একটি টিম গঠন করেন। তাঁরা অত্যন্ত সতর্কতার সাথে নির্ভুলভাবে এই মসহাফের কপি করেন। হযরত ঊসমান (رضي الله عنه) একটি কপি নিজের কাছে এবং একটি মদিনার মূহাফেজখানায় রেখে অবশিষ্ট কপিগুলো সত্যায়ন করে বিভিন্ন প্রদেশের শাসনকর্তাদের কাছে প্রেরণ করেন। আর মূল কপি ফেরত পাঠান হযরত হাফসার (رضي الله عنه) কাছে। [৩]

হযরত ঊসমানের (رضي الله عنه) সময় কপি করা হয়েছিল বলে ইতিহাসে এ মূসহাফ পরিচিতি লাভ করে ‘মূসহাফে ঊসমানী’ নামে।

চিত্র: তাসখন্ডে সংরক্ষিত উসমানী মূসহাফ।

  মূসহাফে উসমানী-র সত্যায়িত একটি কপি এখনো সংরক্ষিত আছে মধ্য এশিয়ার উজবেকিস্তানের তাসখন্দ মিউজিয়ামে।  

চিত্র: টপকাপি মূসহাফ ।

দামেস্কে প্রেরিত মূসহাফের অবিকল প্রতিলিপি সংরক্ষিত আছে তুরস্কে ইস্তাম্বুলের টপকাপি মিউজিয়ামে ও যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরিতে। মূল কপি এবং হরিণের চামড়ায় তৈরি কাগজে  মূসহাফের প্রতিলিপি সংরক্ষিত আছে মিশরের দারুল কুতুব সুলতানিয়ায়।

চিত্র: মীশরে সংরক্ষিত উসমানী মূসহাফ ।

এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা  ও ঐতিহাসিক দলীল প্রমাণ গুলো যাচাই-বাছাই সহ যাবতীয় বিষয়ের সারগর্ভ আলোচনার জন্য অন্যতম প্রামাণ্য দুটি গ্রন্থ হলো মুফতি ত্বকী উসমান হাফিজুল্লাহ রচিত ‘ঊলুমুল কুরআন ’ এবং ড: আলি বিন সুলাইমান আল আবীদ প্রণিত ‘ জামাঊল কুরআনি হিফজান ওয়া কিতাবান ’ । উক্ত গ্রন্থ দ্বয়ে স্পস্ট দলীল প্রমাণের মাধ্যমে মুনকিরে হাদীস, রাফেজী, খৃষ্টান মিশনারী ও প্রাচ্যবীদের সকল বিভ্রান্তি ও আপত্তির খন্ডন করা হয়েছে । (আলহামদুলিল্লাহ )

মূসহাফে ঊসমানী বিভিন্ন স্থানে প্রেরিত হওয়ার পর প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যক্তিগত পর্যায়ে কুরআন কপি করার প্রচলন শুরু হয়। শতাব্দী পরিক্রমায় কুরআনের হাজার হাজার কপি সর্বত্র প্রচার লাভ করে। ইসলামের ইতিহাসের সকল যুগের কপি করা কুরআনের পাণ্ডুলিপির বিশাল সংগ্রহ রয়েছে ওয়াশিংটনের লাইব্রেরি অব কংগ্রেস, আয়ারল্যান্ডের চেস্টার বিয়াটি মিউজিয়াম ও ইংল্যান্ডের লন্ডন মিউজিয়ামে। এসব পাণ্ডুলিপির সাথে তাসখন্দ মিউজিয়াম, ইস্তাম্বুলের টপকাপি মিউজিয়াম ও মিশরে কায়রোর আল-হোসেন মসজিদে সংরক্ষিত মূসহাফ মিলিয়ে দেখা গেছে যে, মূল মূসহাফের লিখনের সাথে এগুলোর কোথাও কোনো অমিল নেই।  

জার্মানির মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয়ের The Institute for Koranforschung [৪] হাতে লেখা ৪২ হাজার কপি পূর্ণ বা আংশিক কুরআন সংগ্রহ করে। দীর্ঘ ৫০ বছর গবেষণা করার পর ইনস্টিটিউট এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে, পাণ্ডুলিপি পাঠে কোনো পার্থক্য নেই। দুর্ভাগ্যবশত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বোমাবর্ষণে ইনস্টিটিউটটি ধ্বংস হয়ে যায়। তবে তার গবেষণা ও রিপোর্ট গুলো সংরক্ষিত রয়েছে ।  আল্লাহর (ﷻ)অনুগ্রহ আর সাহাবীদের (رضي الله عنهمه)আন্তরিক ও বস্তুনিষ্ঠ প্রয়াসের ফলে নাজিল হওয়ার সময় যেভাবে পঠিত হয়েছে, ১৪ শত বছর ধরে সারা পৃথিবীর ঘরে ঘরে এই একই কুরআন সেভাবেই পঠিত হচ্ছে। কুরআন একমাত্র ধর্মগ্রন্থ, যা তার মূল ভাষাকে ধরে রেখেছে এবং মূল ভাষাতেই পঠিত ও চর্চিত হচ্ছে। সেই একই কুরআন। একই ১১৪টি সূরা। একই  ৬,২৩৬টি আয়াত।

॥ ২ ॥

কালের বিবর্তনে প্রয়োজনের প্রেক্ষিতে কুরআনের লেখ্যরূপ বিবর্তিত হয়েছে। মূসহাফে উসমানী লেখায় নুকতা, জের, জবর, পেশ ইত্যাদির কোনো ব্যবহার ছিল না। সাধারণ আরবী লেখায় এখনো ওপরে বা নিচে বর্ণ পার্থক্যকারী কোনো চিহ্ন ব্যবহৃত হয় না। আরবরা শব্দের গঠন দেখেই বর্ণের উচ্চারণ করে। আর বাক্যের গঠন দেখেই আরবরা হ্রস্ব-স্বর উচ্চারণে পার্থক্য করে নেয়। হযরত ওমরের (رضي الله عنه) সময় খিলাফত অন্য ভাষাভাষী অঞ্চলে সম্প্রসারিত হয়। হযরত ঊসমানের (رضي الله عنه) ও হযরত আলীর (رضي الله عنه) সময় খীলাফত আরো ভিন্ন ভাষাভাষী অঞ্চলে বিস্তৃতি  করে। বর্ণ ও পাঠসহায়ক চিহ্ন ছাড়া কুরআন পাঠে ভবিষ্যতে তারা ব্যাপক ভুলত্রুটির শিকার হতে পারে, এই আশঙ্কা দেখা দেয়। হযরত আলী (رضي الله عنه) বিশিষ্ট ভাষাবিদ আবুল আসাদ দোয়েলীকে বিষয়টি সুরাহা করার দায়িত্ব দেন। তিনি মূসহাফে উসমানী-তে তাশকিল অর্থাৎ পাঠসহায়ক জের, জবর, পেশ ব্যবহার করেন।  বর্ণপরিচায়ক নোকতা ব্যক্তিগত মূসহাফে প্রথম ব্যবহার করেন হযরত হাসান আল বসরী ও আল্লামা ইবনে শিরিন। আবুল আসাদ দোয়েলী ও তার ছাত্র নসর ইবনে আসিম ও ইয়াহিয়া ইবনে আমর ৫০ হিজরিতে কুরআন লেখায় ‘বর্ণপরিচায়ক’ নোকতা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে মূসহাফে ব্যবহার করেন।  ৬০ হিজরিতে তৎকালীন আমির আবদুল মালেকের নির্দেশে সকল মসহাফে বাধ্যতামূলকভাবে নূকতা ও তাশকীল প্রয়োগের কাজ সুসম্পন্ন হয়।  

কুরআনের প্রাথমিক কপি মূসহাফে উসমানী-তে কোনো সূরার আগে সূরার নাম লেখা হয় নি। রেখা টেনে বা ( ﷽) বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীমকে আলাদা করে ওপরের লাইনে লিখে এক সূরা থেকে আরেক সূরাকে পৃথক করা হয় নি। আয়াতগুলোও কোনো চিহ্ন বা সংখ্যা দিয়ে আলাদা করা হয় নি। ধারাবাহিকভাবে একের পর এক লিখে যাওয়া হয়েছে। হিজরী প্রথম শতাব্দীর শেষ দিকে সূরার ওপর সূরার নাম এবং ‘﷽’  ওপরের লাইনে আলাদা লেখার এবং দুই আয়াতের মাঝে চিহ্ন বা সংখ্যা দেয়ার পদ্ধতি চালু হয়। [৫] 

হিজরি দ্বিতীয় শতকের প্রথমভাগে প্রতিদিন সমপরিমাণ তেলাওয়াত করে সাত দিনে পাঠ সম্পন্ন বা খতম করার সুবিধার জন্যে কুরআনকে ‘সাত মনজিলে’ ভাগ করা হয়।প্রতিবার তেলাওয়াতের হিসাব রাখার সুবিধার্থে হিজরি দ্বিতীয় শতকের শেষার্ধে কুরআনকে ৫৫৮ ভাগে ভাগ করে প্রত্যেক ভাগের নাম দেয়া হয় রুকু। ৩০ দিনে কুরআন খতম করার সুবিধার্থে কুরআনকে ৩০ পারায় ভাগ করা হয় হিজরি তৃতীয় শতাব্দীর প্রথমার্ধে।  আর হাজার বছর ধরে কুরআনের এই লিখিত রূপই চালু রয়েছে সারা বিশ্বে। [৬]  

॥ ৩ ॥ 

কুরআনের আয়াতমালা অবিকৃত ও বিশুদ্ধ রাখার ক্ষেত্রে অনন্য ভূমিকা রেখেছে একে মুখস্থ রাখার সহজাত আগ্রহ। রসুলুল্লাহর (ﷺ) জীবন হচ্ছে কুরআনের শিক্ষার প্রতিচ্ছবি। আর কুরআন নাজিল হয়েছে ২৩ বছর সময় নিয়ে। তিনি শুধু কুরআন শিক্ষাই দেন নি। পুরো কুরআন তাঁর মুখস্থ ছিল। তাঁকে অনুসরণ করে কুরআন মুখস্থ করতে সাহাবীদের আগ্রহের কোনো অভাব ছিল না। হযরত আবু বকর, ওমর, উসমান, আলী, আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ, আবু হুরায়রা, আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস, আবদুল্লাহ বিন আমর, হযরত আয়েশা, হযরত হাফসা, হযরত উম্মে সালমা (رضي الله عنه) প্রত্যেকেই হাফীজ ছিলেন। পুরো কুরআন তাঁদের মুখস্থ ছিল। রসুলুল্লাহর (ﷺ) জীবদ্দশায় মদিনাতেই হাফীজের সংখ্যা কয়েক হাজার ছাড়িয়ে যায়।[১]  সাহাবী, তাবেয়ী, তাবে তাবেয়ীদের জীবন আবর্তিত হয়েছে কুরআনকে ঘিরে। তারা কুরআন মুখস্থ করেছেন, কুরআনের জ্ঞানে নিজেরা জ্ঞানী হয়েছেন এবং অন্যকে কুরআনের জ্ঞান শিক্ষা দিয়েছেন অবশ্য পালনীয় কর্তব্য হিসেবে। আর দিনে পাঁচ বার কুরআনের মুখস্থ করা অংশ থেকে তেলাওয়াত করা তো নামাজ কায়েমের জন্যে বাধ্যতামূলক। আবার রাতে দীর্ঘসময় নামাজে দীর্ঘ সূরা পাঠ পরিণত হয় অনেকের দৈনন্দিন অভ্যাসে। সেই যুগে এমন কোনো শিক্ষিত পরিবার ছিল না, যেখানে অন্তত একজন হাফেজ ছিলেন না।  কালের বিবর্তনে কুরআন মুখস্থ করা শিক্ষার একটি অংশে পরিণত হয়। হাজার হাজার হীফজখানা প্রতিষ্ঠিত হয়। কুরআন নাজিলের প্রায়  ১৫ শতাব্দীর  পরও কুরআন মুখস্থকারীর সংখ্যা কোনোভাবেই হ্রাস পায় নি, বরং বেড়েছে। মুসলমানদের এমন কোনো পাড়া বা মহল্লা নেই, যেখানে আরব-অনারব, কালো-সাদা, ধনী-গরিব, নারী-পুরুষ কেউ না কেউ কুরআন মুখস্থ পারেন না। এই হিফজ শিক্ষার শুরু রসুলুল্লাহ (ﷺ) থেকে। তাঁর মাধ্যমে শিখেছেন সাহাবীরা (رضي الله عنه)। আর তাঁদের সত্যায়িত প্রক্রিয়াতেই এখনো প্রতি বছর হীফজ করছেন হাজার হাজার হাফীজে কুরআন ।  দুনিয়ায় অনেক ধর্মগ্রন্থ রয়েছে— তাওরাত, জিন্দাবেস্তা, উপনিষদ, বেদ, বাইবেল, গীতা, ধম্মপদ। আছে অনেক সেক্যুলার গ্রন্থ—দর্শন, কাব্য, উপন্যাস। আপনি প্রশ্ন করতে পারেন, এই গ্রন্থ ও রচনাবলির কতটা কতজন মুখস্থ বলতে পারবেন? খোঁজ করলে কদাচিৎ দুই-একজনকে পাওয়া গেলেও যেতে পারে। কিন্তু যদি কুরআন মুখস্থকারীর সংখ্যা জানতে চান, তবে এ সংখ্যা হবে কোটি কোটি । আর এই কোটি কোটি  হাফীজের স্মৃতিতে সংরক্ষিত কুরআন এবং মূসহাফে উসমানী থেকে কপি করা মুদ্রিত কোটি কোটি কুরআন একই কুরআন। সংরক্ষণ ও বিশুদ্ধতায় কুরআন এ-ক্ষেত্রে অনন্য।  এই বাস্তবতা ও ঐতিহাসিক তথ্যই প্রমাণ করে কুরআনে প্রদত্ত আল্লাহর(ﷻ‎) অঙ্গীকারের সত্যতা : 

‘নিশ্চয়ই আমি এই অভিজ্ঞান ( জিকির) নাজিল করেছি এবং আমি একে রক্ষণাবেক্ষণ করব।’ [৭]

তথ্যসূত্র:

[১] তারিখুল ইসলাম লি জাহাবী, সিয়ারু আলামীন  নুবালা, আনসাবুল আশরাফ ।  

[২]  তারিখে ইবনে খালাদূন, তারিখে তাবারী, তারিখুল  ইসলাম লি জাহাবী, তারিখে দিমাশক । 

[৩] খালিফা বিন খাইয়াত, সাহীহ বুখারী ৪৯৮৬ -৪৯৮৭ নং হাদীস, ফাতহুল বারী ৯:১১  ।

[৪]

[৫] আল ইসবাহ, তারিখে দিমাশাক, তারিখূল ইসলামি লি জাহাবী, আখবারুত তিওয়াল ।  

[৬] আল ইত্তিকান, খালিফা বিন খাইয়াত, তারিখে তাবারী , আল কামীল ফিত তারীখ, সিয়ারু নুবালা আলআমীন । 

[৭] আল কুরআন,সূরা আল হীজর , আয়াত ১৫:৯ ।